আসছে পহেলা বৈশাখ। আর এ পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে দিনরাত চলছে বাঁশ বেত দিয়ে কৃষি ও গৃহস্থালীর জিনিস তৈরির কাজ। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বৈশাখী মেলায় এসব পণ্য বিক্রি করার জন্য সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় কুটির শিল্পের কাজ। চলে আবার রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে তৈরি করছে বাঁশ বেতের জিনিস পত্র। তৈরী শেষে করা হচ্ছে রঙ। পাইকাররা এসে এসব পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে বৈশাখী মেলায় তুলবে বলে।
বৈশাখ উপলক্ষে এমন কর্ম ব্যস্ততা চলছে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা এলাকার সন্ন্যাসী পাড়ার দাস সম্প্রদায়ের পরিবার গুলোতে। এ গ্রামের সন্ন্যাসী পাড়ায় কমপক্ষে ৪৫ টি দাস সম্প্রদায়ের পরিবার বাস করছেন। সব পরিবারের ঘরের আনাচে কানাচে বাঁশ বেতের তৈরি জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
বাড়ির মধ্যে বসে বাঁশ বেত হতে ধারালো দা-বঁটি দিয়ে নিপুণ হাতে কেউ তুলছেন বেতি বা চটা। আর এগুলো দিয়ে কেউ বুনছেন চাটাই, ডোল, ঝুড়ি, ডালা, কুলা, টেপারীসহ বিভিন্ন কৃষি ও গৃহস্থালী জিনিসপত্র। আবার কেউ ব্যস্ত তৈরিকৃত গৃহস্থালী জিনিসপত্রে রঙ দিয়ে নকশা ও বাজারজাত করতে।
কারিগররা জানান, তাদের অধিকাংশ পরিবারেরই মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি নেই। বসত ভিটের দু’এক কাঠা জমিই তাদের সম্বল। তারপরও পূর্ব পুরুষদের বাঁশ বেতের কুটির শিল্পের পেশা আকড়িয়ে প্রতিদিনের কম বেশি রোজগারের মাধ্যমে টিকে আছেন। অনেকে হয়েছেন স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে তাদের সংসার। সংসারে আয় রোজগারে এটাই তাদের একমাত্র পেশা। পূর্ব পুরুষদের হতে ধারাবাহিক ভাবে পাওয়া এ পেশা আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা। এখন তাদের মধ্যে দু’একজন অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়লেও তাদের পরিবারের মহিলারা সবাই গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি সারা বছর ধরে বাঁশ বেতের জিনিসপত্র তৈরি করে থাকেন। আর এগুলো পাইকারেরা বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বৈশাখের আগে কাজের চাপ বেশি থাকে।
এছাড়াও পুরুষদের কেউ কেউ আবার তৈরিকৃত কৃষি ও গৃহস্থালীর জিনিসপত্র ভ্যানসহ বহনযোগ্য যানবাহনে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েরা শিশুকাল হতেই লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি অবসর সময়ে পরিবারের বড়দের কাজে সহযোগিতা করতে করতে তারাও এ সমস্ত কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ফলে তারা সাংসারিক জীবনে গিয়ে চাকরি বা ব্যবসা না করতে পারলেও কেউ বেকার হয়ে বসে থাকে না। বরং পরিবারের পেশাটা ধরে বেঁচে থাকতে পারে।
কারিগর গুরুপদ দাস জানান, তাদের বাবা দাদারা বাঁশ বেতের কাজ করতেন। এখন তাদের ৩ ভাইয়ের সংসারেও এ কাজ করে জীবিকা আসছে। বিগত এক দশকে প্লাষ্টিক ও এ্যালোমিনিয়ামের গৃহস্থালীর জিনিসপত্র দেশে ব্যাপক ভাবে প্রচলনের কারণে তাদের তৈরিকৃত জিনিসের চাহিদায় একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু এলাকায় এখন পান ও সবজি চাষ ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এগুলো বাজারজাত করতে ডোল ও ঝুড়ির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুন বেশি।
তিনি জানান, বাঁশ বেতের দাম বাড়লেও কোন প্রভাব পড়েনি। কেননা উৎপাদন ব্যয় যেহারে বেড়েছে সে হারে তারা উৎপাদিত মালামালে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে থাকেন। ফলে তাদের কোন লোকসানের ভয় নেই।
একাধিক কারিগর জানান, কৃষিকাজে অনেক সময় বৈরী আবহাওয়ায় প্রকৃতিক দুর্যোগে প্রভাব ফেলে। আবার কোন কোন সময়ে উৎপাদিত পন্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষকেরা। কিন্তু প্রাকৃতির দুর্যোগে তাদের তৈরিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে গেলেও লোকসান হয়না। বরং তাদের এ পেশার সাথে জড়িতরা প্রতিদিনের রোজগারে তিল তিল করে নগদ পয়সা জমাতে পারেন। সেটার পরিমান বেশি না হলেও অন্য পেশার মানুষের চেয়ে তারা খানিকটা আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকতে পারেন।
বিশ্বনাথ দাস নামের এক কারিগর জানান, এখন একটি মাঝারি গোছের বাঁশ কিনতে ১’শ থেকে দেড়শ টাকা খরচ পড়ে। প্রতি বাঁশ হতে ১টা ধান রাখার বড় ডোল তৈরি করা যায়। আবার ওই বাঁশ থেকে পান বাজার জাতের ডোল তৈরি করা হলে ২ টা ডোল তৈরি করা যায়। এছাড়াও প্রতিটি বাঁশ হতে ৪ টা বড় ঝুড়ি, কমপক্ষে ১০ টি কৃষকের মাথার টোপর, অথবা সর্বনিম্ন তিন’শ টাকা মূল্যের লম্বা চাটাই তৈরি করা যায়। বাজারে প্রতিটি বড় ঝুড়ি এখন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, ছোট ডালা ৯০ থেকে ১০০ টাকায়, কৃষকের মাথার টোপর ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, ধান ও কৃষি পণ্য কৃষাণীদের হাতে ঝাড়ানোর কুলা ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, বাঁশ কিনে বাড়িতে ফাড়াই করে তার প্রকৃতি দেখে বুঝে ওই বাঁশ দিয়ে জিনিস তৈরি করে থাকেন। ফাড়াইকৃত বাঁশের তিনটি স্থর থেকে তিন ধরনের জিনিস তৈরি করলে ভাল গুণগত মানসম্পন্ন টেকসই হয়।
তিনি জানান, একজন অভিজ্ঞ কারিগর সারাদিন পরিশ্রম করলে প্রতিদিন ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা রোজগার করতে পারেন। আর বৈশাখের আগে চাহিদা বেশি থাকায় বেশি পণ্য তৈরী হয়। উপার্জনও বৃদ্ধি পায়।
বয়োবৃদ্ধ কারিগর উপেন্দ্র দাস জানান, বিগত ৫৫ বছর ধরে বাঁশ বেত নিয়ে যুদ্ধ করছেন। এক সময়ে বাড়িতে এ সমস্ত জিনিসপত্র তৈরি করে কোন পরিবহন না থাকায় মাথায় বয়ে ৯/১০ মাইল দূরের হাটে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। সে দিনের মত এখন আর কষ্ট নেই। এখন বাড়ি থেকেই পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাদের কষ্ট এখন অনেকটা লাঘব হয়েছে। বিশেষ করে বৈশাখ মাসকে সামনে রেখে আগাম বাইনা পায় তারা।
তিনি আরো জানান, আগে গ্রামাঞ্চলে বন বাদাড়ে প্রধান উপকরণ বেত পাওয়া যেত। যা দিয়ে তারা নানান জিনিস তৈরি করতে পারতেন। এখন বন বাদাড় উজাড় হয়ে যাওয়ায় কাজ চালাতে বাইরের থেকে বেত কিনতে হচ্ছে। তারপরও সব মিলিয়ে তারা ভালো আছেন।
কালীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম জানান, দাস সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাঁশ বেতের কুটির শিল্পে সংসার চালান। বেকারের ধোয়া তুলে বসে না থেকে নিজেরা স্বাধীন মত বাড়িতে বসে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে বিক্রি করেন। প্রতিদিনের রোজগারে তাদের মধ্যে অনেকে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের তৈরী জিনিস ছাড়া বৈশাখ মেলা জমে না। আর সবচেয়ে বড় কথা আগের দিনের চেয়ে তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।