মোল্লাহাট উপজেলায় বিএনপির কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত।

আগের সংবাদ

নাইক্ষ্যংছড়িতে বিজিবির মানবিক কার্যক্রম: ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও সহায়তা প্রদান

পরের সংবাদ

পুলিশ সংস্কারের পথে বাধা কোথায়? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯ প্রস্তাব ও স্বাধীন কমিশন বিতর্ক

প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৫ , ৪:৪৩ অপরাহ্ণ আপডেট: জুলাই ১৭, ২০২৫ , ৪:৪৩ অপরাহ্ণ

পুলিশ সংস্কার: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯ প্রস্তাব, কিন্তু স্বাধীন কমিশনের বিতর্কে মূল বাধা

ঢাকা: দেশে পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরকে ৯টি সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ২২ জুন এই চিঠি পাঠানো হয় এবং পুলিশ সদর দপ্তর ইতোমধ্যে সেগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তবে, পুলিশের সাবেক আইজি ও সংস্কার কমিশনের সদস্যদের মতে, এসব সংস্কার মৌলিক নয় এবং আসল বাধা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯টি প্রস্তাব ও পুলিশের অগ্রগতি: ১. রাতে গৃহ তল্লাশি: সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে গৃহ তল্লাশির ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ২. মামলা ও তদন্ত তদারকি: থানায় মামলা দায়ের এবং এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার (এএসপি সার্কেল) ও পুলিশ সুপার নিয়মিত তদারকি জারি রাখবেন। ৩. ভুয়া মামলায় চার্জশিট: ভুয়া ও গায়েবি মামলায় অনিবাসী, মৃত ও নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই তিনটি নির্দেশনা ‘অনুসরণ করা হচ্ছে’।

৪. মিডিয়ায় অপরাধী উপস্থাপন: বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসাবে উপস্থাপন করা যাবে না। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ‘নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য সকল ইউনিটকে জানানো হয়েছে।’

৫. জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক: থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কোনোভাবেই জিডি গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সব থানায় পর্যায়ক্রমে অনলাইন জিডির কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা জিডি প্রত্যাখ্যানের সুযোগ রাখবে না।

৬. এফআইআর গ্রহণে অনীহা: মামলার এফআইআর গ্রহণে কোনো অনীহা বা দেরি করা যাবে না। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং অনলাইনে এফআইআর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

৭. চাকরি প্রার্থীদের ভেরিফিকেশন: চাকরি প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষা সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট, মার্কশিট ইত্যাদি যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের, তবে পুলিশ এই ভেরিফিকেশনে অংশ নেবে। জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ (ডিএসবি) ম্যানুয়াল সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

৮. পুলিশ ভেরিফিকেশন এক মাসে: চাকরির জন্য সকল পুলিশ ভেরিফিকেশন দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।

৯. ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মনিটরিং: মামলা দায়ের, রেকার চার্জ করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মনিটরিং-এর ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর পুলিশ সদর দপ্তর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।

সংস্কার কমিশন ও স্বাধীন পুলিশ কমিশনের বিতর্ক: তবে পুলিশের সাবেক আইজি মো. নূরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এগুলো কোনো মৌলিক সংস্কার না। আসল সংস্কার হলো স্বাধীন পুলিশ কমিশন, যা পুলিশকে রাজনীতিসহ বিভিন্ন চাপ থেকে বাঁচিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে।”

পুলিশ সংস্কার কমিশন, যা পুলিশকে জনবান্ধব ও জবাবদিহির আওতায় আনতে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে কাজ করছে, গত ১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে ২২১টির মতো সুপারিশ ও প্রস্তাব আছে, যার মধ্যে ২২টি আইনের সংশোধনও রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন।
  • থানায় কাঁচের ঘেরাটোপ দেওয়া ‘জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ’ তৈরি।
  • নারী আসামিকে শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ।
  • মিডিয়ার সামনে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন না করা।
  • আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা।
  • র‌্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন।
  • জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা।

কমিশন একটি ‘পুলিশ কমিশন’ প্রস্তাব করেছে, তবে এর গঠন, কার্যপরিধি ও সাংবিধানিক দিক বিবেচনা-নিরীক্ষার প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে। এছাড়া, পুলিশের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিটি থানা বা উপজেলায় একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংস্কারের পথে বাধা: কমিশনের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে যে, তারা পুলিশ কমিশন গঠনের যে প্রস্তাব করেছে, তাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিন্নমত জানিয়েছে। পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা মনে করেন, এখনও পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায় বলেই স্বাধীন পুলিশ কমিশনে আগ্রহ নেই।

সংস্কার কমিশনের ছাত্র প্রতিনিধি মো. জারিফ রহমান হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, “সবার আগে দরকার ছিল পুলিশের সংস্কার। কিন্তু সেটাকে গুরুত্বই দেওয়া হলো না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় পুলিশ কমিশনের সুপারিশ না থাকায় আমি আশাহত হয়েছি। এটা জুলাই স্পিরিটের সাথে গাদ্দারি।”

তবে কমিশনের আরেক সদস্য এবং বর্তমানে বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু সাদ মমতাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রতিবেদন দেওয়ার পর আমাদের কোনো কাজ নাই। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের।”

মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান মনে করেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন জটিল কাজ নয়, কিন্তু এটা বাস্তবায়ন না হলে পুলিশে শৃঙ্খলা ফিরবে না এবং নাগরিকদের আস্থাও ফিরবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “পুলিশের মৌলিক সংস্কার হলো পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করা। এটা না করা গেলে আর কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না।”

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়