ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে
ঢাকা: বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের একটি কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হলেও, এই প্রস্তাব নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মহলে তীব্র আপত্তি দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান ফলকার টুর্কের বাংলাদেশ সফরের সময়ই ঢাকায় সংস্থাটির কার্যালয় চালুর বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল।
সিদ্ধান্তের পটভূমি: আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গত ২৯ জুন জানিয়েছেন, “জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ঢাকায় একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাবে উপদেষ্টা পরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে।” তিনি আরও বলেন যে, এ বিষয়ে একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক অনুমোদিত হয়েছে, যা এখন কয়েকজন উপদেষ্টা কর্তৃক পরীক্ষানিরীক্ষার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের কাছে পাঠানো হবে। এই কার্যালয়টি প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য স্থাপন করা হবে এবং পরে প্রয়োজনে এর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।
বিরোধিতার মূল কারণ: এই ইস্যুতে এর আগেও বিরোধিতা দেখা গেছে। গত বছর ফলকার টুর্কের ঢাকা সফরের পরপরই হেফাজতে ইসলামসহ বামপন্থী দলগুলো এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।
ইসলামপন্থীদের আপত্তি: হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেওয়া হবে না। তার মতে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এই দেশের সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো ইসলামী মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মানবাধিকারের’ নামে ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা করেছে দাবি করে তিনি এটিকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এবং মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতির পরিপন্থী বলে মনে করেন।
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী জানান, তারা একটি কমিটি গঠন করেছেন যারা বিশ্বের অন্যান্য দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই অফিস স্থাপন হলে সমকামিতা উৎসাহিত হবে, কাদিয়ানি (আহমদিয়া), সংখ্যালঘু, পাহাড়ি ইত্যাদি ইস্যু তৈরি হবে এবং নারীদের ইসলামের বিধিবিধানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে, যা দেশের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি আরও দাবি করেন যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় কোনো ঘটনা নেই এবং যা আছে তা সরকারই দেখছে। ইসলামী আন্দোলনও একই যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে।
বামপন্থীদের বিরোধিতা: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এই কার্যালয় স্থাপনের বিরোধী, তবে তাদের কারণ ভিন্ন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, বাংলাদেশ এমন কোনো দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পড়েনি যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিসের প্রয়োজন হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। তার মতে, তারা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীর স্বার্থরক্ষা করছে এবং মানবাধিকারের নামে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে আসতে চাইছে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সমালোচনা করেছেন।
মানবাধিকার কর্মী ও প্রগতিশীলদের সমর্থন: এদিকে, মানবাধিকার কর্মী ও প্রগতিশীলরা এই সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য নূর খান মনে করেন, এই অফিস স্থাপন তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এবং এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সহায়তা করবে। তিনি আশাবাদী যে, এটি বাংলাদেশে মানবাধিকার চর্চার একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। নারী বিষয় সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হকও মনে করেন, এই অফিস হলে সরকার মানবাধিকারের ব্যাপারে জবাবদিহিতা ও চাপে থাকবে, যা দেশের জন্য ভালো।
বিএনপির ইতিবাচক মনোভাব: বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য না এলেও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে সই করেছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় এ ধরনের অফিস সহায়ক হবে।
সরকারের অবস্থান: প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ ডয়চে ভেলেকে জানান, উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশের স্বার্থ এবং মানবাধিকারের সব ইস্যু বিবেচনা করেই নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। তিনি মনে করেন, যারা বিরোধিতা করছেন, তারাই এর কারণ বলতে পারবেন, তবে সরকার মনে করে এখানে বিরোধিতার কোনো জায়গা নেই। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট, তাই একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে মানবাধিকার রক্ষায় বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগিতা নেওয়া উচিত।
বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়: সাধারণত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে অফিস স্থাপন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ, প্রতিবেদন তৈরি, কৌশলগত সহায়তা, সচেতনতা তৈরি এবং স্থানীয়দের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্ত করে। জেনেভায় ওএইচসিআর সদরদপ্তর অবস্থিত এবং বিশ্বের ১৬টি দেশে এর কার্যালয় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে সংস্থাটির কার্যালয় বা আঞ্চলিক দপ্তর না থাকলেও, ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪৩টি দেশে তাদের কার্যক্রমের বিবরণ রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের নামও অন্তর্ভুক্ত।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।