ফুটফুটে এক কণ্যা শিশু। এখনো নাম রাখা হয়নি তার। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। সে জানেনা, তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে মা। ঘটনটি ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলা শহরের বহুল আলোচিত বেসরকারী রাবেয়া হাসপাতালে।
জানা যায়, জেলার শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামের আল-আমিন। চাকরি করেন একটি বেসরকারী কোম্পানীতে। গত ২৫ মার্চ সকালে স্ত্রী শারমিন খাতুনকে (২৩) নিয়ে আসেন ঝিনাইদহ জেলা শহরের আরাপপুর এলাকার বহুল আলোচিত বেসরকারী রাবেয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়গনষ্টিক সেন্টারে। সিজার অপারেশন করার পরে দ্বিতীয় সন্তানে মা হন শারমিন। কিন্তু মা ডাক কানে গেলোনা তার। গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে যশোরের বেসরকারী ইবনে সিনা হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তার (শারমিন)। বিকেলেই গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাকে। অজানা ভয়ে স্বজনরা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছেন। তারা কেও মুখ খুলছেন না। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার রেজা সেকেন্দারের ফোন বন্ধ। রহস্য আরো জটিল আকার ধারণ করে। অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে পড়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, শারমিনের অপারেশন হয় গত ২৫ মার্চ দুপুরের দিকে। অপারেশন (সিজার) করেন স্থানীয় ডাক্তার রেজা সেকেন্দার। জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্য শিশু। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে (হাসপাতালের বেডে) দেওয়ার পরেই রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে শরীরের অবস্থার অবনতি হতে থাকে (শারমিনের)। আবারো নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। কয়েক ঘন্টা ধরে ২য় দফায় অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয় তার (শারমিনের)। ১৯ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরেও কোণ উন্নতি হয় না। পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোরের বেসরকারী ইবনে সিনা হাসপাতালে। সেখানে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয় শারমিনকে। গত বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ওই হাসপাতালের ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করেন। লাশ নিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। আইসিইউ বিল হয়েছে প্রায় পোনে দুই লাখ টাকা। নাম প্রকাশ না করার সর্তে স্বজনরা জানান, মামলা মর্কদমা না করলে বিল পরিশোধ করে দেবে রাবেয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়গনষ্টিক সেন্টারের মালিক। রাজি হয়ে যায় শারমিনের স্বামী। যশোর থেকে দুপুরে মরদেহ নিয়ে নিজ গ্রাম মীর্জাপুরে ফিরে আসেন স্বামী আল-আমিন। বিকালে গ্রামের কবর স্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয় শারমিনকে।
কথা হলো বহুল আলোচিত রাবেয়া হাসপাতালের মালিক সোহেল রানার সাথে। হাসপাতালটি পরিচালিত হয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপের ছত্রছায়াতে। সরকারী হাসপাতালে চাকরি করেন এমন অনেক নামী দামি ডাক্তার এর সাথে জড়িত। সোহেল রানা স্বীকার করেন সিজার করার পরে রুগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। রক্ত বন্ধ হয়না। সেকারণে আরেক দফায় অপারেশন করা হয় তাকে (শারমিন)।
তিনি আরো জানান, এক পর্যায়ে যশোরের ইবনে সিনহা বেসরকারী হাসপাতালে (শারমিনকে) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার সকালে মৃত্যু হয়েছে। অথচ মৃত্যু হয়েছে গভীর রাতে। ক্লিনিক মালিক আরো জানান আইসিইউ বিল একলক্ষ ৭০ হাজার পরিশোধ করা হয়েছে। সর্ব মোট দুই লাখ টাকায় ঘটনাটি মিমাংশা করা হয়েছে। এখন কোন ঝামেলা নেই।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মিথিলা ইসলামের সাথে যোগযোগ করা হলে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সিজার করার কিছু সময় পরে রক্তক্ষরণ শুরু হলে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করে ওই রুগীর জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়। এরপরেও রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় যশোরের একটি বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। জানতে পেরেছি ওই রুগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এঘটনায় কেও এখনো অভিযোগ করেনি।
এদিকে শৈলকুপা উপজেলার মীর্জপুর গ্রামে চলছে নিরব শোকের মাতম।গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে শারমিনের স্বজন শৈলকুপা উপজেলার স্থানীয় সংবাদ কর্মি চঞ্চল অভিযোগ করেন, ভুল অপারেশনে শারমিনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। তিনি দাবী করেন শারমিন সর্ম্পকে ভাগ্নি হন। তার (শারমিন) প্রথম সন্তানের বয়স মাত্র দুই বছর। নাম আফিয়া খাতুন।
হরিণাকুন্ডু উপজেলার জনৈক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ক্লিনিক মালিকের দাপটে কেও মুখ খুলতে পারছেনা না বলে জানান চঞ্চল। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায় বেসরকারী ওই হাসপাতালে ইতোপূর্বে ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে। ভুল অপারেশন ও অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন একাধিক মা ও শিশু। র্যাব পুলিশ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু ফলাফল মেলেনি।
ঝিনাইদহের অলি গলিতে গড়ে উঠা বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ডায়গনষ্টিক সেন্টারে রমরমা স্বাস্থ্য বানিজ্য চলছে। সম্প্রতি জারি করা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষিত। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার কিংবা ডিপ্লোমাধারী স্টাফ নার্স। ভোর হতে না হতেই আজব আজব ডিগ্রীধারী ডাক্তারের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়। শব্দ দূষণে দিশেহারা নগরবাসী।
সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেছেন ইতোমধ্যে মানহীন ৮টি বেসরকারি ক্লিনিক ডায়গনষ্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান শুরু করা হবে। তত দিনে ভুল অপারেশন অপচিকিৎসায় অকালে মায়ের মৃত্যু এবং মাতৃ হারা হবে শিশু, স্বজন হারাদের কান্নার জল বাষ্প হয়ে উড়বে আকাশে। এমনটি মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।