প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে রোগীরচাপে তিলধারণের ঠাঁই নেই! চিকিৎসার নামে পকেটকাটা হচ্ছে রোগীর স্বজনদের!
যশোরের ঝিকরগাছা ৫০শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট চরমআকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
ঝিকরগাছা পৌর সদরসহ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের হাট-বাজার জুড়ে ব্যাঙের ছাতারমত গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক এসব বেসরকারি ক্লিনিক।চিকিৎসা সেবার নামে এখানে চলছে রীতিমতো গলাকাটা ব্যবসা। অভিযোগ উঠেছে, সেখানে চিকিৎসার নামে প্রতিনিয়ত আর্থিকভাবে প্রতারিত হচ্ছেন রোগীর স্বজনেরা।চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পকেটকাটা যাচ্ছে তাদের।তারপরও রোগীদের চাপে প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে যেন তিলধারণের ঠাঁই নেই! কারণ হিসেবে জানা গেছে, ৫০শয্যা বিশিষ্ট এই সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে কর্তব্যর চিকিৎসক বলতে মাত্র দুজন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন।খোঁজ নিয়ে জানাগেল, বেশিরভাগ কনসালটেন্ট ডেপুটেশনে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন মাসের পর মাস এমনকি বছরে পর বছর ধরে। অথচ বেতনভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো চিকিৎসক হাজিরা রেজিস্টারে স্বাক্ষর করেই কর্মদিবসের দায়িত্ব শেষ করে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। কনসালট্যান্ট চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকের তিন ঘন্টার বেশি হাসপাতালে কর্তব্য পালনের নজির নেই!
ঝিকরগাছা উপজেলা হাসপাতালে সার্জারি, অর্থপেডিক্স, গাইনি,ডেন্টিস্ট, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞসহ কনসালটেন্ট চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টসহ স্বাস্থ্য সহকারীদের একটি বড় অংশের শূন্যতা থাকায় চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এক্সরে, মলমূত্র, রক্ত, কফপরীক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে পদশূন্যতা থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা তলানিতে ঠেকেছে। এমতাবস্থায় প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চিকিৎসা সেবার আশায় সরকারি এই হাসপাতালে আসলেও কার্যত কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা মিলছেনা। ফলে নিরুপায় হয়ে সেবা প্রত্যাশী রোগীর স্বজনেরা তাই চিকিৎসা সেবা নিতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ছুটছেন বেসরকারি ক্লিনিক গুলোতে। আর এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অতি মুনাফালোভী একশ্রেণির ব্যবসায়ী বেসরকারি ক্লিনিক গুলো। অভিযোগ রয়েছে, গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি বা সিজারিয়ান অপারেশনে গলাকাটা ব্যবসা শুরু করেছে কতিপয় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ । নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবার চার্টার বা সেবামূল্য নির্ধারণী প্রকাশ্য তালিকা রাখা। কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। বেসরকারি এসব ক্লিনিক গুলোতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। ঝিকরগাছা পৌরসদরসহ নাভারন পুরাতন বাজার, ছুটিপুর বাজার, বাঁকড়া বাজার, কায়েমকোলা বাজারে গড়ে উঠেছে এসব ক্লিনিক।অভিযোগ রয়েছে, এসব ক্লিনিকগুলো সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসনের দেয়া স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলেছে।
বৃহস্পতিবার (২৮আগস্ট) ঘড়িরকাঁটা তখন বেলা সাড়ে বারোটা। ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে গেলে চিকিৎসা সেবার এই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেল, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচএ) ডা: আব্দুর রশিদ কিছুক্ষণ আগে উপজেলা পরিষদের একটি মিটিংয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি কর্মস্থলে ফিরে আসেন। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা: হাসান আরিফ ও মেডিকেল অফিসার ডা: ফারহানা ইয়াসমিনকে ৩৯নং কক্ষে রোগীদের চিকিৎসা সেবা করতে দেখা গেছে। এসময় বেশিরভাগ মেডিকেল অফিসারের কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। মেডিকেল অফিসার ডা: পার্থ সারথি রাইকে তার কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছেন ? তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেননি সহকারি সার্জন ডা: রাফেজাতুন জান্নাত। তিনি ছুটিও নেননি! ডেন্টাল সার্জন ডা: মীনাক্ষী বিশ্বাস ছুটিতে আছেন জানাগেল।অর্থপেডিক সার্জন ডা: কামরুজ্জামান ও সার্জারি ডা: তাহমিদুর রহমান সপ্তাহের ৬দিন ডেপুটেশনে থাকেন যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মেডিকেল অফিসার ডা: বিকাশ চন্দ্র ট্রেনিংয়ে যশোরে আছেন। জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) ডা: আনজুমান আরা ও জুনিয়র কনসালটেন্ট ( শিশু) ডা: আবু ইউসুফ যশোর পুলিশ লাইন্সে ডেপুটেশনে রয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানাগেল,প্রসূতি ও গাইনি বিভাগসহ বেশিরভাগ কনসালটেন্ট চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে ডেপুটেশনে রয়েছেন। কেউ আছেন ছুটিতে। আবার কেউবা হাজিরা খাতায় নাম লিখিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একটি বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি,ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সংকটের এমনচিত্র নিত্যনৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক ব্যাপার! রোগীর চাপসৃষ্টি হলে বেডে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের মেঝেতে ঠাই হয় রোগীদের। এক্ষেত্রে আগন্তুক ডায়রিয়া কিংবা বিষপান রোগীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা চরমে ওঠে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসাসেবা ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের সাব সেন্টারগুলোতে একজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার কথা। অথচ উপজেলার নাভারন ইউনিয়নের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন চিকিৎসক ছাড়া সবকটি কেন্দ্র চিকিৎসকশূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। জানাগেছে,উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের অমৃতবাজার উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ হাজিরবাগ, গদখালি, পানিসারা,ঝিকরগাছা, নির্বাসখোলা,শংকরপুর,শিমুলিয়া ও বাঁকড়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকার কথা একজন ইউএনটি কনসালটেন্ট,রিহ্যাবিলিটেশন একজন, চক্ষু বিশেষজ্ঞ একজন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ একজন, চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ একজন, কার্ডিওলজিস্ট একজন ও মেডিকেল অফিসার একজন। অথচ বর্তমানে কোন কেন্দ্রে একজন চিকিৎসকও নেই। জানাগেল,৩৩জন স্বাস্থ্য সহকারীর মধ্যে মাত্র ১৩জন দায়িত্ব পালন করছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আব্দুর রশিদ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য সহকারীদের তীব্র সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধের সরবরাহ আছে দাবী করে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্লাড ব্যাংক’ চালু করার মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। মুমূর্ষু রোগীদের জরুরী রক্তের প্রয়োজনে আমরা সাধ্যমোতাবেক আমাদের ব্লাড ব্যাংক থেকে প্রয়োজন মেটাতে পারছি। নিজ উদ্যোগে নতুন কিছু নিয়ম চালু করেছি দাবি করে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরো জানান, হাসপাতালের দৈনন্দিন আন্ত ও বহির্বিভাগের সেবা গ্রহীতা ও প্রত্যাশী রোগীদের তালিকা হালনাগাদ ও রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক করেছি।পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের হাসপাতাল অভ্যন্তরে অযাচিত আনাগোনা ও দালালমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলেছি।