যশোর সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামের মেধাবী এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমাইয়া ছায়ার জীবন থেমে গেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। রিকশার চাকার সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি।
গত শুক্রবার দুপুরে দড়াটানা থেকে বোনের বাড়ি খড়কির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ছায়া। যশোর শিল্পকলা একাডেমির সামনে পৌঁছালে হঠাৎ করেই তার গলায় জড়ানো ওড়না রিকশার চাকার সাথে পেঁচিয়ে যায়। মুহূর্তেই তার গলায় ফাঁস লেগে নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি।
তার সঙ্গে রিকশায় থাকা দুলাভাই রোকন জানান, সকালে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার সময় ছায়া আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে হিজাব খুলে গলায় ওড়না জড়িয়ে নেন। বাসায় ফেরার সময়ই ঘটে দুর্ঘটনাটি। স্থানীয়রা সঙ্গে সঙ্গে ওড়না কেটে তাকে উদ্ধার করেন। সে সময় তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল এবং ঘাড়ের ডান পাশে গুরুতর আঘাত ছিল।
প্রথমে ছায়াকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু তার জটিল অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা ঢাকায় রেফার করেন। পরে ইবনে সিনা হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালের নিউরো সার্জন ডা. ফিরোজ আহমেদ আল-আমিন তার ঘাড়ে জটিল অপারেশন করেন। তিনি জানান, দুর্ঘটনায় ছায়ার ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড আলাদা হয়ে যায় এবং স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যায়, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি করে। অপারেশনের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের হাড়গুলো জোড়া লাগালেও ছেঁড়ে যাওয়া স্পাইনাল কর্ড আর ঠিক করা সম্ভব হয়নি।
ডা. আল-আমিন বলেন, ছায়ার ঘাড়ের ৫ ও ৬ নম্বর হাড়ের মাঝখান দিয়ে স্পাইনাল কর্ড দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, যার ফলে শরীরের ঘাড়ের নিচের অংশ স্থায়ীভাবে অচল হয়ে গেছে। এমনকি নিজে থেকে নিঃশ্বাস নেওয়াও তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।
অপারেশনের পর ছায়ার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। নিবিড় পর্যবেক্ষণে ১৪ ঘণ্টা রাখার পর সোমবার তাকে বেডে নেওয়া হয়। সে সময় ছায়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতেও সক্ষম হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরবর্তীতে মঙ্গলবার রাত ১২টার পর পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার ফুসফুসে পানি জমেছে এবং অক্সিজেন লেভেল আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
অবস্থা অবনতি হলে রাত ১টার দিকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। বর্তমানে ছায়ার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ছায়ার বড় বোন শোভা জানান, বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় ছায়া কাঁপা কাঁপা ইশারায় বলছিল, “আমার হাত-পা কেন নড়ছে না? আমি কিভাবে লিখবো? কিভাবে পরীক্ষায় যাব?” এরপর সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ধীরে ধীরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালে ছায়ার মা মিনি বেগম, বড় বোন মিতু ও অন্যান্য স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো তরতাজা ছায়ার জন্য তাদের হৃদয় এখন কান্নায় ভাসছে।
এদিকে, গ্রামের বাড়িতে তার অসুস্থ বাবা মারফত হোসেন খাওয়া-ঘুম ছেড়ে মেয়ের জন্য দোয়া করতে করতে দিন পার করছেন। চারদিকে পরীক্ষার্থীরা যখন এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো দিচ্ছে, তখন ছায়া হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। স্বজনদের একটাই প্রার্থনা—সুমাইয়া ছায়া যেন আবার ফিরে আসে, সুস্থ হয়ে, নতুন জীবন নিয়ে।