Print

Rupantor Protidin

গোপালগঞ্জের সংঘর্ষ: নিহতদের শরীরে গুলির আঘাত, দায় এড়াচ্ছে বাহিনী; তদন্ত কমিটি গঠন

প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ১৯, ২০২৫ , ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: জুলাই ১৯, ২০২৫, ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

Sheikh Kiron

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ: নিহতদের শরীরে গুলির আঘাত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন; তদন্ত কমিটি গঠিত

গোপালগঞ্জে গত বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সমাবেশ ঘিরে সংঘটিত হামলায় নিহতদের শরীরে গুলির আঘাত ছিল বলে তাদের পরিবার জানিয়েছে। এই ঘটনায় মারণাস্ত্র ব্যবহার ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, যা চারজনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য: পুলিশ প্রধান বাহারুল আলম বুধবার ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “পুলিশ কোনো লেথাল (প্রাণঘাতী) আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি।” অন্যদিকে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং ছবিতে সেনাসদস্যদের প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। পুলিশেরও গুলি করার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষই নিহত চারজন তাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করছে না।

আইএসপিআর (আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দপ্তর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাজনৈতিক সংগঠনের সমাবেশ চলাকালে মঞ্চে হামলা এবং জেলা কারাগারে ভাঙচুর করা হয়। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

তদন্ত কমিটি গঠন ও সরকারের প্রতিশ্রুতি: গোপালগঞ্জের বুধবারের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে পুরো ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে, “অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সরকার ন্যায় বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

গোপালগঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি: বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। গোয়েন্দা তথ্য ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে এত পরিমাণ যে হবে, ওই তথ্য হয়তো ছিল না।”

বুধবারের ঘটনায় নিহত চারজনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন আছে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বুধবার রাত থেকে গোপালগঞ্জ শহরে কারফিউ বলবৎ আছে। বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান কারফিউ শুক্রবার সকাল ১১টা পর্যন্ত চলবে। তিন ঘণ্টা বিরতির পর শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। শহরে পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী ও বিজিবি টহল দিচ্ছে এবং থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

নিহত ও আহতদের পরিবারের অভিযোগ: নিহত সোহেল রানার মামা জাহিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, তার ভাগ্নের পায়ে এবং বুকে গুলি লেগেছে। তিনি আরও বলেন, “কার গুলিতে সে মারা গেছে তা আমরা বলতে পারবো না।” নিহত আরেকজন ইমনের চাচা শাকিল মোল্লা অভিযোগ করেন, ইমনকে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কে পায়ে গুলি করার পর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বুট জুতা দিয়ে আঘাত করা হয়। ইমনের খালাতো ভাই রমজান তাকে বাঁচাতে গেলে তাকেও মারধর করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেশ বিশ্বাস জানান, নিহত চারজনকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আহত ২০-২৫ জনের অধিকাংশের শরীরেই গুলির আঘাত আছে।

মানবাধিকার কর্মীদের সমালোচনা: মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, “গোপালগঞ্জে নিহত চারজনের মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না।” তারা একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছে। আসক আরও মনে করে, জনসাধারণের ওপর বল প্রয়োগ, গুলি চালানো ও প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড ও সংবিধানের চরম লঙ্ঘন। তারা প্রশ্ন তুলেছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার কথা বললেও গুলি কারা করলো?

এনসিপি’র অভিযোগ: এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন অভিযোগ করেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। তিনি বলেন, “তারা পরিস্থিতি জানতো। কিন্তু সেই অনুযায়ী পর্যাপ্ত ফোর্স রাখেনি। সেখানে তো আমাদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল।” তিনি আরও বলেন, “নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের লোকজনের হাতেও তো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারাও তো গুলি ছুড়েছে।”

ঘটনার সূত্রপাত: গোপালগঞ্জে বুধবার এনসিপির সমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকেই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় ছিল। এনসিপি’র ‘পদযাত্রা’ গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নাম দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিভিন্ন খবর ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার ঘিরেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বুধবার সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর মুক্তমঞ্চে এনসিপির সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল। এনসিপি নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় বুধবার দুপুর ২টার দিকে শহরে প্রবেশ করেন। তবে তার আগে সকাল সাড়ে ৯টায় পুলিশের গাড়িতে এবং সকাল সাড়ে ১১টায় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। সমাবেশ শুরুর আগে পৌর মুক্তমঞ্চে এনসিপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ওঠার কিছুক্ষণ পর ৫০-৬০ জনের একটি দল মঞ্চ ভাঙচুর করে আগুন দেয়। সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রবেশ পথে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। মঞ্চে আগুনের পর পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এরমধ্যেই এনসিপি নেতারা বেলা দুইটার পরপর সমাবেশ শুরু করেন এবং ৪০ মিনিটের মধ্যে তা শেষ করেন। সমাবেশ করে ফেরার পথে শুরুতেই এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা হয়। তারা বিকল্প পথে ফেরার চেষ্টা করলে আবারও হামলা হয়। সেই অবস্থায় এনসিপি নেতারা জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং পরে সেনাবাহিনীর এপিসিতে করে বিকাল ৫টার দিকে গোপালগঞ্জ ত্যাগ করে খুলনায় যান।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকজন আগেই শহরে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাদের লক্ষ্য ছিল এনসিপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া। কয়েক ঘণ্টা ধরে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।

এই ঘটনায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বুধবার সৈয়দপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “আমরা যে পুলিশ বাহিনী নিয়ে কাজ শুরু করেছি, সেই পুলিশ আওয়ামী সরকারের নিয়োগ করা। তারা আমাদের পুরোপুরি সহযোগিতা করছে না। শেখ হাসিনা পুরো রাষ্ট্রকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছেন।”