বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা
যশোরে ৩ মাসে ১৮ হত্যাকাণ্ড: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ, উঠছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রশ্ন
যশোর: গত তিন মাসে যশোরের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জমিজমা, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধের জেরে সংগঠিত এসব হত্যাকাণ্ড জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সচেতন নাগরিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অবহেলা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন।
হত্যাকাণ্ডের চিত্র: জানা যায়, গত ১২ মে যশোর শহরের ষষ্টিতলায় সন্ধ্যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বিপুল নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে। তার পরিবারের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছিল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চেয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাননি। কৌশলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বিপুলকে হত্যা করা হয়। শুধু বিপুল নন, গত ২২ মে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি তরিকুল ইসলামকেও ঘের ইজারা দেওয়ার নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে গত তিন মাসে যশোরে জমিজমা, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধের জেরে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে কুপিয়ে, গুলি করে, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও রয়েছে, যা জনমনে চরম আতঙ্ক তৈরি করেছে।
সচেতন নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত: যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক শেখ মাসুদুজ্জামান মিঠু উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “৫ আগস্টের পর একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো। সাধারণ মানুষ মনে করেছিলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে। কিন্তু খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইয়ের মত অপরাধ বেড়েছে। এতে করে আমরা অনেক শঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করছি।”
তিনি আরও বলেন, “পুলিশ একটি অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ঘটনা ঘটার পর তারা রুটিন ওয়ার্ক করছে। কিন্তু অপরাধের লাগাম টানতে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ, চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধার ও এলাকা ভিত্তিক নিয়মিত অভিযান তার কিছুই করছে না। এতে করে আমরা শঙ্কায় আছি আগামী দিনগুলোতে এ ভয়াবহতা আরও বাড়বে কীনা।” তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করার দাবি জানান।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, “যশোরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সারা দেশেই একই অবস্থা। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করছে না। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কাজ না করায় চরমপন্থী, সন্ত্রাসীদের উত্থান হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের ধরা হচ্ছে না। এসব নানাবিধ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে।”
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও যশোর সরকারি এম এম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি একদিনে হয়নি। এটি হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চরম রূপ। আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। পাশাপাশি মানুষজন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। তারা বিচার দেখতে না পেয়ে বিচারকে হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে।” তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষ অবচেতন মনে তা অনুকরণ করার প্রবণতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
হামিদুল হক শাহীন আরও বলেন, “জুলাই আন্দোলনের পরে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাষ্ট্রের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। পরিবারও পরিবারের দায়িত্বটা পালন করতে পারছে না। ফলে মানুষের মনোজগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বিভৎস প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর থেকে বের হতে হলে যে অন্যায় করছে তার বিচার হতে হবে, পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে, শিক্ষক সমাজকে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্ব নিতে হবে, সমাজের সর্বস্তরে পরিপূর্ণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।”
পুলিশের বক্তব্য: তবে এ বিষয়ে যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, “প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রুততম সময়ে ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। হয়তো একটি ঘটনায় জড়িত সব অপরাধীকে আমরা আইনের আওতা আনতে পারিনি; কিন্তু আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।”
তিনি আরও বলেন, “পারিবারিক বিরোধ নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো প্রতিরোধে আমরা থানা, ক্যাম্প, ফাঁড়ির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও করছি। যাতে কেউ অপরাধ কাণ্ডে না জড়িয়ে প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেয়।” অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, পুলিশ একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সরব রয়েছে এবং সিনিয়র অফিসারদের দিয়ে যা তদারকি করা হয়।
প্রসঙ্গত, যশোর জেলা পুলিশ গত তিন মাসে ২ হাজার ৯২ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে নিয়মিত মামলার আসামি ৮৭৪ জন, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ১ হাজার ১৯২ জন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্যান্য আইনে ২৮ জন।