Print

Rupantor Protidin

মেটাকে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান দাবি করে মামলা, সাক্ষ্যে যা বললেন জাকারবার্গ

প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ১৭, ২০২৫ , ১২:৩৭ অপরাহ্ণ | আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২৫, ১২:৩৭ অপরাহ্ণ

Sheikh Kiron

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কম্পানি মেটার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি)। সোশ্যাল মিডিয়া খাতে একাধিপত্য বজায় রাখার অভিযোগে এই মামলা করা হয়েছে। এফটিসির মতে, মেটার একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা সুরক্ষা কমেছে।

মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশনের (এফটিসি) দায়ের করা অ্যান্টিট্রাস্ট মামলার ট্রায়ালের শুরুতে ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দেন।
বছর কয়েক আগেই জাকারবার্গ অনুমান করেছিলেন যে, এমন পরিস্থিতিতে তিনি পড়তে পারেন—এমনকি তিনি নিজেই ইনস্টাগ্রামকে আলাদা করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছিলেন।

এফটিসির দাবি, মেটা প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে নিয়ে (যেমন: ২০১২ সালে ইন্সটাগ্রাম ও ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ) প্রতিযোগিতাকে দমিয়ে রেখে অবৈধভাবে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। এ ছাড়া মেটা তার ক্ষমতা ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপগুলোকে এপিআই সুবিধা বন্ধ করে দেয়া ও প্রতিযোগীদের বৈশিষ্ট্য নকল করার মাধ্যমে প্রতিযোগিতাকে দমন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি।

সাক্ষ্যগুলো থেকে উঠে এসেছে, কিভাবে জাকারবার্গ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দেখেন এবং কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়া দ্রুত পরিবর্তনশীল হয়ে উঠছে, যাতে মেটার মতো কম্পানিকে টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব পরিবর্তনের কারণে ব্যবহারকারীরা টিকটক ও ইউটিউবের মতো প্রতিযোগী প্ল্যাটফর্মে ঝুঁকে পড়ছে।

এই মামলায় মেটা অনেক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ, মামলায় হারলে কম্পানিটিকে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ আলাদা করে দিতে হতে পারে।

নিচে মার্ক জাকারবার্গের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষ্যে তিনি উপস্থিত হন ফেসবুকের সাবেক সিওও শেরিল স্যান্ডবার্গের আগে।

ইনস্টাগ্রামকে আলাদা করার কথা ভেবেছিলেন জাকারবার্গ

২০১৮ সালে জাকারবার্গ কম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘বড় টেক কম্পানিগুলো ভাঙার দাবি যখন বাড়ছে, তখন আমাদের ইনস্টাগ্রাম এবং সম্ভবত হোয়াটসঅ্যাপকেও আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে আলাদা করে দিতে হতে পারে—এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ আদালতে উপস্থাপিত এক ইমেইলে এমন তথ্য দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটে জাকারবার্গ ইনস্টাগ্রামকে আলাদা করে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, কম্পানির ‘অ্যাপসের পরিবার’ কাঠামো ফেসবুকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তার ভাষ্য, অধিকাংশ কম্পানি আসলে বিভক্ত হওয়ার পর আরো বেশি সফল হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপকে আলাদা করা হয়নি। এখন সেই সিদ্ধান্ত রক্ষা করতেই আদালতে লড়ছে মেটা।

ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে—এই আশঙ্কা ছিল জাকারবার্গের

এফটিসির আইনজীবী ড্যানিয়েল ম্যাথেসনের জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থাপিত নথিতে বলা হয়েছে, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে অধিগ্রহণের আগেই চিন্তিত ছিলেন জাকারবার্গ।

২০১১ সালে তিনি বুঝতে পারেন, ফেসবুকের ‘ফেসবুক ক্যামেরা’ ফিচার কার্যকারিতা এবং জনপ্রিয়তায় ইনস্টাগ্রামের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে।

এক ইমেইলে তিনি লেখেন, ‘এই বিষয়ে আমরা নিজেকে সংগঠিত করতে যতটা সময় নিয়েছি, ততদিনে ইনস্টাগ্রাম মোবাইল ফটো শেয়ারিংয়ে আমাদের জন্য একটি বড় ও কার্যকর প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে, যেটা ভবিষ্যতের ফটো শেয়ারিংয়ের দিকনির্দেশনা।’ এরপর ২০১২ সালের এপ্রিলে ফেসবুক ১ বিলিয়ন ডলারে ইনস্টাগ্রাম অধিগ্রহণ করে।

২০১২ সালে তৎকালীন সিওও স্যান্ডবার্গকে লেখা একটি ইমেলে জাকারবার্গ জানান, ওই সময়ের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মাইক শ্রোফার ও তার দল প্রযুক্তিগতভাবে ভালোভাবে কাজ করলেও ফলাফল সন্তোষজনক নয়।

তিনি লেখেন, ‘মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপকে হারাতে পারছে না। ইনস্টাগ্রাম এত দ্রুত বড় হচ্ছিল যে, আমাদের বাধ্য হয়ে তাদের ১ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিতে হয়েছে। এটা তেমন বড় সাফল্য নয়।’

২০১৩ সালে জাকারবার্গ তৎকালীন গ্রোথ হেড জাভিয়ের অলিভানকে বলেছিলেন, হোয়াটসঅ্যাপ যদি ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার নিয়ে আসে, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজারে এগিয়ে যেতে পারে। জবাবে ওলিভান বলেন, ‘আমি রাতে ঘুমাতে পারি না, হোয়াটসঅ্যাপ যদি সত্যিই বড় হয়ে যায় এই ভয়ে।’

ওই সময় ফেসবুকের মধ্যে এই উদ্বেগও ছিল যে, গুগল হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করে নিতে পারে। তবে বুধবার আদালতে মেটার আইনজীবীর প্রশ্নে জবাব দিতে গিয়ে জাকারবার্গ বলেন, হোয়াটসঅ্যাপের সহপ্রতিষ্ঠাতা জান কউমের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর তিনি মনে করেছিলেন, প্রতিযোগিতামূলক ফিচার তারা তৈরি করবে, এমন সম্ভাবনা ‘অত্যন্ত কম’।

২০১৪ সালে ফেসবুক ১৯ বিলিয়ন ডলারে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করে। জাকারবার্গ আদালতে দাবি করেন, এই দুই প্ল্যাটফর্ম অধিগ্রহণ করে মেটা ব্যবহারকারীদের জন্য সেগুলোকে আরো উন্নত করেছে।
ফেসবুকে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলার হার কমেছে

ফেসবুক মূলত বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও কনটেন্ট শেয়ার করার জন্য তৈরি হয়েছিল। এফটিসি বলছে, এই সেক্টরেই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে মেটা। তবে জাকারবার্গ স্বীকার করেন, এখন আর সেই উদ্দেশ্যে ফেসবুক তেমনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

মঙ্গলবার এফটিসির আইনজীবী ২০২২ সালের একটি অভ্যন্তরীণ নথির কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয়েছে ‘নতন বন্ধু হওয়া ও বন্ধুদের সঙ্গে কনটেন্ট শেয়ার কমে যাচ্ছে।’

জাকারবার্গ বলেন, ‘বিশেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার পরিমাণ কমছে। এমনকি মানুষ নতুন বন্ধুও আগের তুলনায় কম যোগ করছে… তবে সঠিক সংখ্যাটা আমার জানা নেই।’ তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যত শুধুমাত্র কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের দখলে থাকা ফিড নয়, বরং ব্যক্তি বা বন্ধুদের গ্রুপে মেসেজিং অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, ‘মেসেজিং উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে ফিডে শেয়ার করা কমছে।’
ইউটিউব এখন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী

শুধু টিকটক বা স্ন্যাপচ্যাট নয়, গুগলের ইউটিউবও ফেসবুকের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে বলে বলেছেন মেটার প্রধান নির্বাহী। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ইউটিউব দারুণ জনপ্রিয়। পিউ রিসার্চ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ জন কিশোরের নয়জন ইউটিউব ব্যবহার করে, অন্যদিকে ফেসবুকের ব্যবহার গত এক দশকে ব্যাপকভাবে কমেছে।

জাকারবার্গ বলেন, ‘আমার যতটুকু ধারণা… মানুষ ইউটিউবে সময় কাটায় ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম মিলিয়ে যতটুকু সময় কাটায় তার সমান বা তার চেয়েও বেশি। অবশ্যই আলাদাভাবে প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের চেয়ে বেশি।’

তবে এখনও যুক্তরাষ্ট্রে মেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড় অংশ দখল করে রেখেছে। পিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর এক চতুর্থাংশই মেটার।

সূত্র : সিএনএন