Print

Rupantor Protidin

সাধারন মানুষ অসহায়

চট্টগ্রামে মাদকের নিয়ন্ত্রণ ২০ গডফাদারদের হাতে, কেনাবেচা হয় ৫০ স্পটে

প্রকাশিত হয়েছে: নভেম্বর ৩০, ২০২৪ , ৬:২০ অপরাহ্ণ | আপডেট: নভেম্বর ৩০, ২০২৪, ৬:২০ অপরাহ্ণ

Sheikh Kiron

চট্টগ্রামে মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তারা গডফাদার হিসেবে পরিচিত। তাদের হাতেই মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এদের অনেকে প্রভাবশালী নেতা। যারা সবাই অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। তাদের রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স ও সম্পত্তি। সবাই নিজ নিজ এলাকায় আত্মগোপনে থেকে কৌশলে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় সম্প্রতি মাদক গডফাদারদের একটি হালনাগাদ তালিকা তৈরি করেছে। যার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীতে মাদক গডফাদারদের সংখ্যা হলো ২০ জন। এদের মধ্যে কয়েকজন নারী মাদক ব্যবসায়ীর নামও আছে। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে।

মাদকের গডফাদার হিসেবে তালিকায় এক নম্বরে আছে নগরীর সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রক মো. ইউসুফের নাম।

বাকিরা হলেন, সিআরবি চৌদ্দ জামতলা বস্তির মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ফয়সাল, হালিশহর বড়পোল এলাকার করিম ওরফে ডাইল করিম, সদরঘাট ধোপার মাঠ বস্তির মাইজ্যামিয়া, সিমেট্রি রোড এলাকার আরমান, বাকলিয়া কালামিয়া বাজারের আলী জহুর, বাকলিয়ার আমজাদ, সেলু, বাবু, রেয়াজুদ্দিন বাজারের জাহিদ, আকবরশাহ থানার সিডিএ ১ নম্বর রোড এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মো. আলমগীর, মো. খোরশেদ ও বাবলু, সদরঘাট থানার আইস ফ্যাক্টরি রোডের মরিচ্যাপাড়া এলাকার মো. ফারুক রানা, মো. চাঁন মিয়া, খাতুনগঞ্জ ওসমানিয়া লেনের মো. দিদার, বাকলিয়া থানার রাজাখালী এলাকার রাবেয়া, বশরী, বকুলী, আজগর, মনির হোসেন কেহেরমান, খুলশী থানা এলাকার আলাউদ্দিন আলো, ফোরকান, শাকিল, ইব্রাহিম, জাফর, জুয়েল, জোসনা, ভুলু, বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় রেজিয়া ওরফে রাজিয়া, মুক্তা, মনিকা, পারভিন, আঁখি, ডবলমুরিং এলাকার পিচ্চি আলো, প্রকাশ সালাউদ্দিনের ভাই এবং বন্দর থানা এলাকার ইকবাল।

গডফাদারদের পাশাপাশি তালিকায় ৩৫৯ জন মাদক কারবারির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকাটি ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা মাদকদ্রব্য। মাদক কারবারিরা ধরাও পড়লেও আড়ালে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। ফলে কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা ধরা পড়ছে তারা খুচরা বিক্রেতা। এই ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকে সেই গডফাদাররা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, অভিযোগ রয়েছে মহানগরের বিভিন্ন থানার অসাধু পুলিশ সদস্যরা এদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মাসোহারা নিচ্ছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকপাচার, বেচাকেনার ক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বাবা-মা খবর রাখছেন না তার ছেলে-মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে আর কী করছে। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সময় দিচ্ছেন না। এতে করে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইয়াবা সিন্ডিকেট চক্র হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাঠাচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মদসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগরীর ১৬টি থানায় মাদকের গডফাদারদের সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মাদক ব্যবসা সমন্বয় করছে থানার ক্যাশিয়াররা।

এই ব্যপাওে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির এক ঊধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জল, স্থল, নৌ ও রেলপথ থাকায় চট্টগ্রাম মাদক পরিবহনের প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন কৌশলে চট্টগ্রামে মাদক ঢুকছে। কিছু গডফাদার চট্টগ্রামে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। আমরা তাদের তালিকা করেছি। আসলে মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করতে হলে আমাদের পাশাপাশি অন্যান্য আইনয়োগকারী সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দেশে সরবরাহ হচ্ছে। প্রতিদিনই ইয়াবা পাচার হচ্ছে। আবার প্রতিদিনই ধরাও পড়ছে। কিন্তু পাচারের তুলনায় জব্দ হচ্ছে খুব কম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের বেশির ভাগই মাদক মামলার আসামি। প্রতিদিন আসছেন আর জামিনে মুক্তিও পাচ্ছেন। মাদকাসক্ত বন্দীদের নিয়ে বেকায়দায় থাকতে হয়। মাদকের জন্য তাঁরা ছটফট করেন। কারা হাসপাতালে রেখে তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

৫০ স্পটে মাদক সেবন ও কেনাবেচা:
চট্টগ্রাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীর অন্তত ৫০টি স্পটে মাদক বেচাকেনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কোতোয়ালি থানার বরিশাল কলোনী, পুরাতন রেল স্টেশন, ১৪ নম্বর আমতলী বস্তি, বয়লার কলোনি, বিআরটিসি এলাকা, মনোহরখালী, ফিশারিঘাট, নজুমিয়া লেন, মিরিন্ডা লেন, লালদীঘি, ঘাটফরহাদবেগ, পোস্ট অফিস গলি ও এনায়েতবাজার গোয়ালপাড়া। বাকলিয়া থানার চর চাক্তাই, তক্তারপুল, ভাইল বেপারীর গলি, রাহাত্তারপুল, মাস্টারপুল, বালুরমাঠ, বৈদ্যারটেক, রাজাখালী, পুলিশ বিট, বউবাজার ও তুলাতলী পয়েন্ট। চকবাজার থানার ধুনিরপুল, চাঁন মিয়া মুন্সী লেন, কার্পাসগোলা ব্রিজ ও চক সুপার মার্কেট এলাকা। পাঁচলাইশ থানার খতিবের হাট, ষোলশহর রেলস্টেশন, হামজারবাগ রেলওয়ে গেট, আমীন কলোনি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকা। সদরঘাট থানার মাদারবাড়ি রেলগেট এলাকা, রেল বিট পানির টাঙ্কি ও শাহজাহান হোটেল।

খুলশী থানার পাহাড়তলী বাজার পাওয়ার হাউজ কলোনী, রেলওয়ে কিন্ডার গার্টেন বাউন্ডরীর ভিতর, রেলওয়ে স্কুলের পিছনে, জোর ডেবার পাড়, তালতলা ঝিলের পাড়, পাহাড়তলী কলেজের ভিতরে, বাটালি হিল, মতিঝর্ণা, টাইগারপাস বস্তি, ট্যাঙ্কির পাহাড়, শহীদনগর লেন ও বিহারি কলোনি। বায়েজিদ থানার আরফিন নগর বিশ্ব কবরস্থান সংলগ্ন, শেরশাহ কলোনী, ঝর্ণা কলোনি, রৌফাবাদ রেলওয়ে কলোনি, মুক্তিযোদ্ধা কলোনী, জামতলা, ডেবার পার, কলাবাগান, আরেফিন নগর, ভাঙা বাজার ও আমিন জুট মিল। চান্দগাঁও থানার মেসতুা চৌধুরী ঘাটা, রাহাত্তারপুল এজাহার মিয়ার বাড়ি, কালুরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে এবং কাপ্তাই রাস্তার মাথা।