শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরা
অফিস করছেন না চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। বাকি ১৬ কাউন্সিলরের মধ্যে ৭ জন অফিস করলেও অনিয়মিত। নিয়মিত অফিস করছেন মাত্র ৯ জন। তবে এরা সবাই সংরক্ষিত কাউন্সিলর। গতকাল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চসিকের এক প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে অনুপস্থিত কাউন্সিলরদের বেশিরভাগ ‘নিরাপত্তা’ ও ‘মামলার হয়রানি’ এড়াতে অফিস করতে পারছে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন চসিকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, জাতীয়তা, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্তত ১৭ ধরনের সেবা দেয়া হয় ওয়ার্ড অফিস থেকে। কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় এসব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। তাই করণীয় নির্ধারণে কয়েকদিন আগে চসিককে অনুপস্থিত কাউন্সিলরদের তালিকা পাঠানোর নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এর প্রেক্ষিতে তালিকাটি পাঠানো হয়।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কোন কোন কাউন্সিলর অনুপস্থিত রয়েছেন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে সে তথ্য জানতে চেয়েছে। এর প্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিনিধি সরেজমিন ঘুরে তালিকা প্রস্তুত করেছে। অতি গোপনীয়ভাবে সে তালিকা আজ (গতকাল) মন্ত্রণলায়ে প্রেরণ করেছি।
চসিকের ওয়ার্ড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হামলা চসিকের ওয়ার্ড কার্যালয়ে। এতে ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬টি ওয়ার্ড কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া সংরক্ষিত ওযার্ডেও ৫টি কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়। এরপর আত্মগোপনে চলে যান চসিকের ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। এরপর ১১ আগস্ট ওয়ার্ড সচিবদের সঙ্গে সভা করে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাহী। পরদিন ওয়ার্ড সচিবরা কাজে যোগ দিলেও যোগ দেননি বেশিরভাগ কাউন্সিলর। পরবর্তীতে হাতেগোনা কয়েকজন কাউন্সিলর অফিস করেন। এরপর বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হলে আত্মগোপনে চলে যান কাউন্সিলররা।
বিঘ্ন ঘটছে নাগরিক সেবায় : জানা গেছে, চসিকের ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম সেবা হচ্ছে জাতীয়তা, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ। এছাড়া নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকার (ওয়ারিশ), আয়, অবিবাহিত, ২য় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদও দেওয়া হয়। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মশক ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজের তদারকি এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কাজও পরিচালিত কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে।
এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণকে সহায়তা করা এবং ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় এই ধরনের সেবা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। গত ২২ আগস্ট ভারী বর্ষণে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাহাড় ও আশপাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কাজে কাউন্সিলরদের কাউকে সক্রিয় দেখা যায়নি।
যেসব কাউন্সিলর অনুপস্থিত : চসিকে ওয়ার্ড আছে ৪১টি। এত ৪১ জন সাধারণ এবং ১৫ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর আছেন। সবমিলিয়ে কাউন্সিলর আছেন ৫৫ জন। সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যে অফিস করছেন না ৩৭ জন। যে চারজন করছেন তারাও অনিয়মিত। সংরক্ষিত বা কাউন্সিলরদের মধ্যে অফিস করছেন না ২ জন। বাকিদের মধ্যে চারজন অনিয়মিত এবং ৮ জন নিয়মিত অফিস করছেন।
সাধারণ কাউন্সিলর মধ্যে অফিস করছেন না– ৪ নম্বর চান্দগাঁ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. এসরারুলল হক, ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. কাজী নুরুল আমিন, ৬ নম্বর ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম আশরাফুল আলম, ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী, ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলম, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ (মঞ্জু), ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইসমাইল, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল, ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিন, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদুল আলম, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হারুন উর রশীদ, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নূরুল আলম, ২০ নম্বর দেওয়ান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সলিম উল্ল্যাহ, ২৩ নম্বর উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জাবেদ, ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল হক (ডিউক), ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইলিয়াছ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শেখ জাফরুল হায়দার চৌধুরী, ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাহাদুর, ২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ী ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মো. জোবায়ের, ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ী ওয়ার্ড কাউন্সিলর আতাউল্লা চৌধুরী, ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবদুস সালাম, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাবু জহর লাল হাজারী, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ (বিপ্লব), ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ড কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর, ৩৫ নম্বর বঙিরহাট ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল হক, ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোর্শেদ আলী, ৩৭ নম্বর উত্তর মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবদুল মান্নান, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মো. চৌধুরী, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালি শহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা আবদুল বারেক, ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী। অফিস না করা দুই সংরক্ষিত কাউন্সিলর হচ্ছেন – সংরক্ষিত ওয়ার্ড–৫ এর কাউন্সিলর আনজুমান আরা ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৮ এর কাউন্সিলর নীলু নাগ।
অফিস না করার কারণ নিরাপত্তা : ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চসিক নির্বাচন। এতে ৫৫ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে জয়ী হওয়া সবাই আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কেউ দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এবং কেউ দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। দলের প্রধান শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা।
কাউন্সিলরা কেন অফিস করছেন তা তাদের পক্ষে ওয়ার্ড সচিবরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন চসিক সচিবকে। এতে নিরাপত্তার বিষয়টি ওঠে আসে। যা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, নিরাপত্তার কারণে অফিস করছেন ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান মুরাদ। নিরাপত্তা ও অসুস্থতার কারণে অফিসে আসছেন না পাঠানটুলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। মামলার হয়রানি এড়াতে এবং নিরাপত্তার কারণে কার্যালয়ে অনুপস্থিত আছেন উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ।
ওয়ার্ড কার্যালয় ভাঙচুর ও লুটপাট করার কারণে সশরীর অফিস করছেন না উত্তর হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইলিয়াছ। তারা বাসা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড সচিবেরা। কয়েকজন কাউন্সিলরের পক্ষে জানানো হয়, ৫ আগস্ট ওয়ার্ড কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জিনিসপত্র লুট করে। সব নথিপত্র জ্বালিয়ে দেয়। এতে দাপ্তরিক কাজ করার মত পরিবেশ না থাকায় তারা অফিস করতে পারছেন না।