Print

Rupantor Protidin

খোলা হলো চট্টগ্রাম কাপ্তাই বাঁধের জলকপাট

প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ২৫, ২০২৪ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ | আপডেট: আগস্ট ২৫, ২০২৪, ৬:৪০ অপরাহ্ণ

Sheikh Kiron

হ্রদের পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় খুলে দেওয়া হয়েছে কাপ্তাই হ্রদের স্প্রিলওয়ে বা জলকপাট। ছয় ইঞ্চি করে খুলে দেওয়ায় এখন হ্রদ থেকে সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক পানি নির্গত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। তবে দেশের একমাত্র এই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে প্রতিদিনেই এর অন্তত সাড়ে তিন গুণ পানি নিষ্কাশন করা হয় কাপ্তাই হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীতে। রোববার (২৫ আগস্ট) সকাল ৮টায় কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) এ টি এম আব্দুজ্জাহের।

কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দেওয়া অংশে ১২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের ১৬টি জলকপাট রয়েছে। এগুলো দিয়ে সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন হতে পারে। এর ধারণক্ষমতা ১০৯ এমএসএল (মিনস সি লেভেল)। তবে পানি ১০৭ এমএসএল পেরিয়ে গেলে তথা বিপৎসীমার কাছাকাছি গেলে জলকপাট দিয়ে পানি নির্গমণ করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুজ্জাহের বলেন, হ্রদের পানি ১০৮ এমএসএল পেরিয়ে গেলে সাধারণ জলকপাট খুলে দেওয়া হয়। রোববার সকাল ৮টার দিকে হ্রদে পানির উচ্চতা ছিল ১০৮ দশমিক ৩২ এমএসএল। এ কারণেই জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন সেকেন্ডে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৯ হাজার কিউসেক পানি নির্গম হচ্ছে কর্ণফুলীতে। দেশের পূর্ব, উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যায় রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কয়েকটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করেই বেড়েছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। দৈনিক দুই থেকে আড়াই এমএসএল করে পানি বেড়েছে হ্রদে।

এমন পরিস্থিতিতে শনিবার দুপুরে বিপৎসীমার কাছাকাছি পানি হওয়ায় পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এদিকে বর্তমানে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে ৩২-৩৩ হাজার কিউসেক পানি প্রতি সেকেন্ডে কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশন হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেকের বেশি পানি এখন নিষ্কাশন হচ্ছে এই হ্রদ থেকে।

বিপিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, সারা দেশের বিদ্যুতের অব্যাহত চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে বছর জুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকতে হয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে টারবাইনের মাধ্যমে বাইরে ফেলা পানি মিলিত হয় কাপ্তাই হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীর অংশে। সেই পানির শেষ গন্তব্য কর্ণফুলী নদী বয়ে বঙ্গোপসাগর।

প্রকৌশলীরা আরও বলছেন, সারা বছর পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন করা না গেলে সমুদ্রের পানি জোয়ারের মাধ্যমে চলে আসে কর্ণফুলীতে। এতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত মদুনাঘাট পানি নিষ্কাশন কেন্দ্রের পানিতে লবণাক্ততার প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম নগরে ওয়াসার সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থায়। এ কারণে সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে পানি নিঃসরণ করতে হয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। কাপ্তাই হ্রদের পানির ‘অর্থনৈতিক গুরুত্ব’ থাকায় বিপৎসীমায় না পৌঁছানো পর্যন্ত পানি ছাড়ে না কর্তৃপক্ষ।

জলকপাট খুলে পানি ছেড়ে দেওয়া দিয়ে অনেক কথা বলেও এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে প্রতিদিনই, যে পরিমাণও বছরের যেকোনো সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০ মেগাওয়াটে নেমে এলেও গত কয়েকদিন ধরেই এই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ ইউনিটে উৎপাদন হচ্ছে। ২১৬-২১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ফলে প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। অর্থাৎ জলকপাট খুলে দেওয়ায় সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে এর প্রায় সাড়ে তিন গুণ পানি নিষ্কাশন হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। প্রবল বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের পূর্ব, উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে কাপ্তাই হ্রদের জলকপাট খুলে দেওয়া তথা পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার এই বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রথম ধাপে কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি স্বয়ংস্ক্রিয় জলকপাট দিয়ে পানি নিঃসরণ করা হয়। পরদিন ১৮ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ছাড়া হয় বাঁধ। এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই ছাড়া হয় কাপ্তাই হ্রদের পানি। সবশেষ গত বছর তথা ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ও ১৯ সেপ্টেম্বর দুই দফায় কাপ্তাই হ্রদের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার আমলে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। এতে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির উপজেলা বিস্তৃত জনপদ ডুবে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। ওই সময় বিশাল এলাকার জনভূমি পানিতে ডুবে উদ্বাস্তু হন পাহাড়ের হাজার হাজার মানুষ। এরপর কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদে পানি সংরক্ষণে করে স্থাপন করা হয়েছে দেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ছিল। পরে এর সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়। সরকারি হিসাবে এর সর্বোচ্চ সক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট বলা হলেও ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের একমাত্র এই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট চলমান থাকলে এখানে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৪০ পয়সারও কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই খরচ দেশের অন্য যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে কম।