যারা আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হবে না। আমাদের মূল টার্গেট অপরাধীরা, কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের জন্য ক্ষতি।
অর্থনীতির জন্য ক্ষতি। কর্মসংস্থান ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
গভর্নর বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাদের মাধ্যমে ও ঠিক কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রথমে সে বিষয়ে তদন্ত হবে। এরপর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা হন তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না। খুব শিগগির একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের চিন্তা করছে সরকার। ব্যাংকিং কমিশন যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংক খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথনকশা প্রদর্শন করবে।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘এমনিতেই আমরা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আরো একটু সংকোচন করার চিন্তা আছে। আশা করি, মুদ্রানীতি আর একটু টাইট করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারও প্রায় স্থিতিশীল।’ তবে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অনেকখানি কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ঠিক কততে নামানো যায় সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এস আলম মালিকানাভুক্ত ছয় ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে আহসান মনসুর বলেন, ‘এই ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার জন্য তারাই দায়ী। তাদের আর কোনো নগদ সহায়তা দেওয়া হবে না। ওই ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন টাকা রাখবে কি না সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। চাইলে তারা টাকা তুলেও নিতে পারে আবার রাখতেও পারে। এখানে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘১০০০ টাকার নোট বাতিলের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কিন্তু নোট বাতিলের এমন কোনো সিদ্ধান্ত আপাতত নেই। বিষয়টি আমাদের বিবেচনায়ও নেই।’ এদিকে গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ব্যবসার নাম করে যারা লুটপাটে জড়িয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ব্যবসায়ী সমাজ সহযোগিতা করবে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদলে ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল প্রমুখ।
গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে আবদুল আউয়াল মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে সম্পদ লুট করেছে, অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন করেছে এবং ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধ কঠোর ব্যবস্থা নিতে গভর্নরকে অনুরোধ করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ভালো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারবেন না।’
গভর্নরের কাছে ব্যাংকঋণের কিস্তি ৩ থেকে ৬ মাস বাড়ানোর দাবি করেছেন বলে জানান এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা ঋণের কিস্তির সময়সীমা ৩ থেকে ৬ মাস বাড়ানোর কথা বলেছি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তার পরও সময় না বাড়লে অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে যাবেন।’
এফবিসিসিআই সভাপতি আরো বলেন, ‘জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। এ বিষয়ে গভর্নর সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন।’ এ ছাড়া গত ১ থেকে ২ মাসে শিল্প-কারখানার ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যবসায়ীদের নমনীয় সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারের কারণে লোকসানে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা গভর্নরকে বলেছি।’
তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ী সমাজ অর্থনীতির পক্ষে। সরকারের যেকোনো ভালো পদক্ষেপে তারা সহায়তা করবেন।
বিগত সরকারের সময়ে ভুল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেগুলো পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা। এই বিষয়টি জানিয়ে মোহাম্মদ হাতেম সাংবাদিকদের বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ভুল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
মোহাম্মদ হাতেম আরো বলেন, ‘গভর্নরের সঙ্গে সভায় আমরা ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। সংস্কার খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সুদহার কমানোর বিষয়ে কথা হয়েছে। সে জন্য গভর্নর ৬ থেকে ৭ মাস সময় চেয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমলে তিনি সুদহার কমানোর বিষয়ে কাজ করবেন।’