চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী গুলীবিদ্ধ হয়ে ৩ জনের মৃত্যু
চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থীসহ ৩জন নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ৩ জন হলেন-মো. ফারুক (৩২). মো. ওয়াসিম (২২) ও ফয়সাল আহমেদ শান্ত। ওয়াসিম চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ফারুক ওয়ার্কশপ কর্মচারী। ওয়াসিমের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় আর ফারুকের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। ফয়সাল এম.ই.এস কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি বরিশাল। তিনজনের লাশ চমেক মর্গে রয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছে, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।
নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন। তিনি বলেন, আন্দোলনের ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে ৩জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তিনজনই গুলিবিদ্ধ। এ ছাড়া আহত অন্তত ২৫/৩০জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে ১০ জনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছে। এ ছাড়া ১ জনের চোখ উপড়ে গেছে।
চমেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. নুজহাত ইনু বলেন, চমেক হাসপাতালে ৩জনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। এর মধ্যে ফারুক নামে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। বাকি ২ জনের মৃত্যুর কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে নগরের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে সড়কে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। এর প্রতিবাদে সীতাকুণ্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। এরআগে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করে। এর ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করা একাধিক ট্রেন আটকে পড়ে দুই পাশে। এ ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৩ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এদিন দুপুর ১টার দিকে ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। বিকেল ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এছাড়া মুরাদপুর, ষোলশহর রেলস্টেশন ও ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকার বিভিন্ন মোড়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন। এ সময় কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হামলা করেছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলী করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। জবাবে তারাও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে মুরাদপুর মোড়ে গিয়ে বেলাল কমপ্লেক্সের একটি বাণিজ্যিক ভবনে আশ্রয় নেন। এরপর ওই ভবনের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধর শুরু করেন।
শিক্ষার্থীরা বলছে, সোমবার বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে আজ (মঙ্গলবার) বিকেল সাড়ে ৩টায় কর্মসূচি ছিল চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে। তবে এর আগে থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে ষোলশহর রেলস্টেশনে অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ষোলশহরের দিকে আসতে থাকেন। আসার পথে মুরাদপুরে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এভাবে চলছে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে নগরের ব্যস্ততম সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। শিক্ষার্থীদের কয়েকটি অংশ অলিগলিতে ঢুকে পড়লে সেখান থেকেও খুঁজে বের করে হামলা করা হয়েছে।
আন্দোলনে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের জশদ জাকির নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আমাদের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মতো একই জায়গায় কর্মসূচি দেন। পরে আমরা মুরাদপুর এলাকায় অবস্থান করলে ছাত্রলীগ বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের ৫/৬ আহত হয়েছেন। ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, নামে ছাত্রলীগ হলেও এরা কেউ ছাত্রলীগের নন। অধিকাংশ টোকাই। তাদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। গুলি করা হয়েছে।
এসময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। কারো কারো হাতে অস্ত্রের দেখাও মিলছে। তবে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দেখা যায়নি। পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছেন কেজিডিসিএল কার্যালয়ের সামনে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ আজ বিকেলে বলেন, নগরের মুরাদপুরসহ যেসব স্থানে সংঘর্ষ হচ্ছে, সেখানে পুলিশ রয়েছে। বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। অস্ত্রধারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে অস্ত্রধারী কেউ থাকলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক কমিটির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম ছাত্রলীগের গুলিতে নিহত হয়েছে। লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেলে আছে। সে চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র। বহদ্দারহাটে থাকতো।
জানতে চাইলে ষোলশহর রেলস্টেশনে থাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম ওরফে রনি বলেন, তারা (আন্দোলনকারীরা) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। ট্রেন অবরোধ করে
মানুষের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন। এই আন্দোলন এখন আর কোটাবিরোধী আন্দোলন নেই। তারা এ আন্দোলন মোকাবিলা করবেন।
৩ প্লাটুন বিজিবি : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চট্টগ্রামে ৩ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। ওইদিন বিকেলে তাদের মোতায়েন করা হয়। বিজিবি চট্টগ্রাম-৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ ছিদ্দিকী বলেন, চট্টগ্রামে ৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিজিবি গাড়ি নিয়ে নগরের মুরাদপুর, অক্সিজেন ও পাহাড়তলী এলাকায় টহল দিচ্ছে।