আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণখেলাপি ও হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি প্রত্যাশা করেছিলাম; কিন্তু বাজেট বক্তব্য শুনে এ বিষয়ে হতাশ হতে হলো। কারণ, ঋণখেলাপি ও হুন্ডিব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কথা বাজেটে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। তবে এটা প্রকৃত চিত্র নয়। বাস্তবে ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে খেলাপি ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঋণগুলো কী অবস্থা তা–ও জানা যাবে না। এই প্রবণতা বাড়তে থাকবে।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে সংকোচনমূলক বাজেট বলতে হবে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি, কর-জিডিপির অনুপাত এবং জিডিপির অনুপাতে বাজেট–ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটি অর্জন করা কঠিন। যদি এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়, তা প্রশংসনীয় হবে।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। যদিও তা এখন ৯ শতাংশের বেশি। সেখান থেকে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন চ্যালেঞ্জ। আদৌ এই চ্যালেঞ্জ পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
প্রসঙ্গত, রোববার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘ঋণখেলাপিদের ধরতে চাই, তাদের ধরব।’ এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরই আলোকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর প্রয়োগ ১ জুলাই থেকে শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু আইনে যে বিধিবিধান রাখা হয়েছে, এর আলোকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করতে কমপক্ষে ৫ মাস সময় লাগবে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির সঙ্গে চিঠি চালাচালি শুরু করলে এর বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে গিয়ে কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আইনের আওতায় আসেনি ঋণখেলাপিরা।
বিভিন্ন সময় অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররাও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তা কার্যত প্রয়োগ হয়নি। এবার ঋণখেলাপিদের ধরতে সরকারের ইচ্ছা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হবে, তা এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দিয়েছে। করোনার আগে থেকে ব্যাংক শুধু ঋণ বিতরণ করেই যাচ্ছে। কোনো ঋণ আদায় করতে পারছে না। করোনার সময় ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে ছাড় উঠে গেলেও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এখনো ঋণ আদায় সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে আদায় একেবারেই নগণ্য। গত বছর শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো মাত্র ২ শতাংশ ঋণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। অন্য খাতেও ঋণ আদায়ে মন্দা। শুধু কৃষি ও গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ঋণ আদায় সন্তোষজনক। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে। খরচ বেড়েছে। ঋণ বিশেষ বিবেচনায় চলমান রেখে সুদ আদায় না করেই খাতায় মুনাফা হিসাবে দেখানো হচ্ছে। ফলে কাগজে মুনাফার ওপর ভর করে ব্যাংক চলছে। এদিকে বিতরণের ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ফলে এর পরিমাণ বাড়ছে। হিসাবের ফাঁকি দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো হলেও বাস্তবে তা অনেক বেশি। ফলে ওইসব ঋণ থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান কমে যাচ্ছে। ফলে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের পুরোটাই এখন আটকে আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণ প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে দেড় লাখ কোটি টাকা এবং ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮৮ শতাংশ। মাত্র ৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ নতুন। বাকি ৪ শতাংশ সন্দেহজনক ঋণ। বাকি সব খেলাপি ঋণই ২ বছরের বেশি পুরোনো। এর মধ্যে ৫৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিপিডি বলেছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা হবে।
খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনার আগে বেশ জোরালো উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ভারতে খেলাপি ঋণ আদায়ের মডেল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই মডেলের আলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইন সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ভারতের আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহক গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক তার সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায় করতে পারে। তার সম্পদ থেকে ঋণ আদায় সম্ভব না হলে তার অন্য কোনো সম্পদের ওপর হাত দিতে পারে।
তাতেও ঋণ আদায় সম্ভব না হলে চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। অর্থাৎ খেলাপি হলে গ্রাহকের সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। গ্রাহকের কোনো সম্পদও থাকবে না।
এর আলোকে অর্থঋণ আদালত আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েও সব ধারা সংযুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে অর্থঋণ আদালত আইনে কোনো গ্রাহক খেলাপি হলে তাকে প্রয়োজনীয় নোটিশ দিয়ে গ্রাহকের বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক বিক্রি করে দিতে পারে। এতে টাকা আদায় না হলে অন্য সম্পদ বিক্রির জন্য আদালতে মামলা করতে পারে। কিন্তু গ্রাহককে নোটিশ দিলেই গ্রাহক আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আইনি কার্যক্রম স্থগিত করে দিতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। একই সঙ্গে ব্যাংক ও ঋণখেলাপির আঁতাতের কারণে মামলার কার্যক্রমও এগোচ্ছে না। দেউলিয়া আইনটিও এখনো পুরোপুরি কার্যকর হতে পারেনি। এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণখেলাপিদের ধরতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আগে নতুন ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে হবে। এজন্য বন্ধ করতে হবে ঋণ জালিয়াতি। ঋণখেলাপিদের ধরতে হলে তাদের সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। ঋণখেলাপিদের পাশের চেয়ারে বসিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড খেলাপি ঋণ আদায়ে সফল হয়েছে। ওইসব পদ্ধতি এদেশেও প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণ রিকভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেছেন, সরকার ঋণখেলাপিদের ধরতে চায় না। কারণ, ঋণখেলাপিরা সরকারের আশপাশের লোক। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে সরকারের কাছের লোকজন নানাভাবে সুবিধা পায়। এসব কারণে ঋণখেলাপিরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এখন ঋণখেলাপিদের ধরতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে ধরা যাবে না। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের কমপক্ষে ১ শতাংশ নগদ আদায় করতে বলেছে। খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে ব্যাংকগুলোকে নীতি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আটকে দেওয়া হচ্ছে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে ঋণখেলাপিদের ধরতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা সংসদেও একাধিকবার প্রকাশ করা হয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক খাত এখন খাদের কিনারে চলে গেছে। এখন ঋণখেলাপিদের ধরা ছাড়া উপায় নেই। ঋণখেলাপিদের আর ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। তাদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারলে ব্যাংক খাতের সংকট অনেকটা কমে যাবে। খেলাপিদের প্রশ্রয় দেওয়া হলে ব্যাংক খাত সঠিক ধারায় এগোবে না।
তিনি আরও বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে শুধু কথার আওয়াজ দিয়ে হবে না। কথাগুলোকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি যে একটি খারাপ সংস্কৃতি, খেলাপি হলে যে শাস্তি পেতে হয়, সেই বার্তা দিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকারদেরও জবাবহিদি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক ছাড়ের কারণে যেমন খেলাপি বাড়ে, তেমনই ব্যাংকারদের কাজের স্বচ্ছতার অভাবেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।