Print

Rupantor Protidin

জাবিতে পরিযায়ী পাখির আবাসে ইআইএ ছাড়া ভবন নির্মান

প্রকাশিত হয়েছে: মে ৩১, ২০২৪ , ৮:২২ অপরাহ্ণ | আপডেট: মে ৩১, ২০২৪, ৮:২২ অপরাহ্ণ

Sheikh Kiron

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) পরিযায়ী পাখির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পুরাতন রেজিস্ট্রারের সামনে অবস্থিত লেকটি। এজন্য লেকটিকে ‘মেইন বার্ডস লেক’ নামে অভিহিত করা হয়। সম্প্রতি সেখানে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে ৬ তলা বিশিষ্ট ‘চারুকলা অনুষদ ভবন’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও করা হয় নি পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বা (ইআইএ)। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন মাধ্যমে ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয় জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় লেকটিকে‌ মেইন বার্ডস লেক নামেই শনাক্ত করা হয়। ৭.১৫ একর আয়তনের লেকটিকে ওই সভায় সংস্কারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ঐ স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে, নির্মাণকালীন সময়ে উৎপন্ন শব্দ ও বিশৃঙ্খলায় লেকটি আর পরিযায়ী পাখির জন্য বাসযোগ্য থাকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির এ সিদ্ধান্ত গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হয় বলেও জানা গেছে।

এদিকে প্রকল্প অফিসে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-ইআইএ) করা হয়নি। তবে কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের সাথে একটি বৈঠকে ফিজিবিলিটি স্টাডিকে (সুবিধাদি পর্যালোচনা) ইআইএ বলে উপস্থাপন করা হয়। এটিকে প্রতারণা বলছেন আন্দোলনকারীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী ও পরিবেশবিদদের দাবি, লেকটিতে পরিযায়ী পাখির প্রধান আবাসস্থল এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় পাঁচশত গাছপালা রয়েছে সেখানে। এসব বিবেচনায় এটি পরিযায়ী পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প জায়গা থাকলেও সেখানে ভবন করতে বললে চারুকলা অনুষদ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ভবন নির্মাণে বিরোধী হিসেবে দেখিয়ে পরিবেশকে ধ্বংস করে ভবন নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।

তারা আরও বলছেন, এখানে ভবন নির্মাণ করা হলে নির্মাণকালীন উচ্চ শব্দে আর কোনো পরিযায়ী পাখি আসবে না। পাশাপাশি লেকটির জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ভবন নির্মাণ নিয়ে চারুকলা অনুষদ কর্তৃপক্ষ বারবার নানা অজুহাত দেখিয়ে আসছে। একান্ত প্রয়োজন হলে বিকল্প জায়গার পরামর্শ দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। আর ইআইএ না করে এতদিন প্রতারণা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, চারুকলা অনুষদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পাসের সব থেকে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ লেকটি অবস্থিত ঐ জায়গায়। কয়েক শতাধিক গাছ কাটা পড়বে বলে জেনেছি। প্রতিবছরই লেকটির পাড়ে অতিথি পাখিরা আসে। ঠিক এমনই একটা জায়গা যখন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে, তখন আসলে তারা চরম অদক্ষতা পরিচয় দেয়। আমরা আসলে ভবনের বিরুদ্ধে না, আমরা চাই ভবন হোক। কারণ চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা যে শ্রেণীকক্ষ সংকটে রয়েছে সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি। যদি ওই জায়গাটায় ভবন করা লাগে তাহলে মাস্টারপ্ল্যান করেই করতে হবে। আর যদি মাস্টারপ্ল্যান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না পারে তাহলে বিকল্প জায়গায় ভবনটি করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, তাদেরকে যখন আমরা বিকল্প জায়গা দেখতে বলি তখন তারা নানা টালবাহানা করে, তাদের ডিজাইন হয়ে গেছে, সার্ভে হয়ে গেছে। তারা বোঝাতে চাই তাদের তাদের অনেক ব্যয় হয়েছে কিন্তু তাদের এই সামান্য ব্যয়ের কারণে তো আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করতে পারি না! টাকা চলে যাবে এই ভয় দেখিয়ে আসলে লাভ হবে নেই, এটা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান না। যে কেউ টাকা দিবে আর যেখানে সেখানে আমরা বিল্ডিং করে ফেলব এটা ভাবলে ভুল হবে।

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের একাংশের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, পরিবেশ-বিজ্ঞানিরা বলছে ওই জলাশয়ের পাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণ হলের পাখির ফ্লাইট জোন নষ্ট হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পাখি কোনোভাবেই আসবে না। এর পাশে একটি একতলা টিনশেড ভবন আছে। সেসময় পাখির কথা চিন্তা করেই সেখানে বহুতল ভবন করা হয়নি। যাতে গাছ দিয়ে টিনশেড ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু এসব আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এখানে বাস্তুতন্ত্রের জন্য সংবেদনশীল জায়গায় ভবন নির্মাণ হলেও ইআইএ করা হয় নি। এটি এক ধরনের প্রতারণা যা মেনে নেওয়া যায় না। এর আগেও সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত মোতাবেক উপাচার্য জাবির সুন্দরবন নামে খ্যাত আইবিএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপে স্থান পরিবর্তনে প্রশাসন বাধ্য হয়েছে। আমরা চাই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ভবন নির্মাণ করা হোক।

পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভুঁইয়া বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিবেচনা করেই। এখানে যতগুলো লেক আছে সেগুলা হল তার সৌন্দর্যের অন্যতম বাহক। নব্বইয়ের দশকে লেকের পাড় গুলোতে এবং যে সমস্ত জায়গায় টিলা রয়েছে সেখানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। একটা ‘গ্রিন জোন’ তৈরি করা হয়েছিল। যার কারণে প্রাণ-প্রকৃতি আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী চেষ্টা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে রক্ষা করে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার। কিন্তু সম্প্রতি অধিকতরে উন্নয়ন প্রকল্পে গাছপালা কেটে ও জলাশয় ভরাট করে খেয়াল খুশি ভবন নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা হচ্ছে। এখানে মাস্টারপ্লানকে বিবেচনায় আনা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যেখানে চারুকলা ভবন তৈরি করা হচ্ছে সেখানে ভবন নির্মাণ একেবারেই অনুচিত। এটাই ছিল আমাদের প্রথম জলাধার যেখানে অতিথি পাখি বসতো। কাজেই সেখানে আবার কীভাবে পাখি ফিরিয়ে নেওয়া যায়, পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল করা যায় সে ব্যবস্থা আমাদের নেওয়া উচিত। এমনই অনেক বিকল্প জায়গা আছে যেখানে তারা ভবন করতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি গঠিত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আকতার মাহমুদ ইআইএ নিয়ে বলেন, চারুকলা অনুষদের জন্য নির্ধারিত জায়গা জীববৈচিত্র্য এবং পরিযায়ী পাখির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থানগুলোতে ভবন নির্মাণের আগে ইআইএ করা বাঞ্ছনীয়। কারণ এই জায়গাকে কেন্দ্র করে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য গড়ে ওঠে। পরিবেশের উপর ভবনটি কীরূপ প্রভাব ফেলবে এটা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম. এম. ময়েজউদ্দিন বলেন, ‘আমরা অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতেই চারুকলা অনুষদের ভবনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করেছি। আমাদের ভবনটি জলাশয়ের কোনো ক্ষতি করবে না। ইচ্ছা করলেই আমরা জায়গা পরিবর্তন করতে পারি না, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আমাদের যে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে আমরা সেভাবেই নকশা করেছি এবং ডিজাইনটা দাঁড় করিয়েছি। ভবন নির্মাণকালে উৎপন্ন উচ্চ শব্দের কারণে যদি পরিযায়ী পাখির কোনো ক্ষতি হয় তবে আমরা কাজ স্থগিত রাখবো। তাছাড়া পরিবেশ কোনো ক্ষতি যাতে না হয় সেভাবেই আমরা কাজ করছি। লেকের পাড়ে ভবন নির্মাণের জন্য এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে বললেও তিনি কোনো রিপোর্ট দেখাতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি ফিজিবিলিটি টেস্ট ছাড়া আর কিছু দেখাতে পারেননি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সংশ্লিষ্ট ভবনের স্থপতি আলিয়া শাহেদকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায় নি।