একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে উপস্থিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। স্বপ্ন থাকে নিজের ও দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর। উপকূলীয় অক্সফোর্ড খ্যাত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (নোবিপ্রবি) দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী ছুটে আসে উচ্চ শিক্ষা জন্য। পরিবার ছেড়ে একজন নবীন শিক্ষার্থী কে এখানে এসেই পড়তে হয় হলের ডাইনিং বন্ধ থাকা, খাবারের উচ্চ মূল্য, অপুষ্টিকর খাবার নিয়ে নানান জটিলতায়।
বর্তমানে নোবিপ্রবিতে ছেলেদের দুটি এবং মেয়েদের তিনটি মিলিয়ে মোট পাঁচটি হলসহ একটি ক্যাফেটেরিয়া এবং বেশকিছু খাবারের দোকান থাকলেও ক্যাম্পাসে মিলছে না মানসম্মত খাবার । “মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আছে খাবারের স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মূল্য। যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে চরম অসন্তোষ। খাবারের মধ্যে পোকা পাওয়া কিংবা বাসি পাঁচ খাবার নিয়ে অভিযোগ নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবাসিক হলগুলোতে ভর্তুকি না থাকা এবং প্রশাসনের অবহেলায়কে এসবের জন্য দায়ী বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
হলগুলো সম্পর্কে খবর নিতে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম হলের ডাইনিং। এতে করে বিপাকে পড়েছেন হলে থাকা চার শতাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ডাইনিং বন্ধ থাকায় তাদের বাধ্য হয়েই কাম্পাসের আশেপাশের টং দোকান থেকে উচ্চমূল্যে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। অতিরিক্ত তেল মসলায় রান্না করা এসব খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ভুগতে হচ্ছে পেটের পীড়াসহ অন্যান্য রোগে। এছাড়াও খাবার নিয়ে বাড়তি ঝামেলার কারণে প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরেই বন্ধ আছে সালাম হলের ডাইনিং। এ জন্য আমাদের নানা রকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এমনকি রমজানে সাহরি খাওয়ার জন্য রাতের বেলা হলের বাইরে গিয়ে টং দোকানে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সেখানে বাড়তি মূল্য পরিশোধ করেও অনেক সময় স্বাস্থ্যকর খাবার মিলে না। উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে প্রায় সময় পঁচা বাসি খাবার জুটে।” সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত ডাইনিং চালুর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান ঐ শিক্ষার্থী।
এ ব্যাপারে হলের ডাইনিং ম্যানেজার শাকিল মোস্তফা’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ৩-৪ মাস ধরেই হলের ডাইনিং বন্ধ পড়ে রয়েছে। দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির ফলে ডাইনিং চালিয়ে কোনো লাভ হয়না। হল প্রশাসনের পক্ষে থেকে শুধু একজন বাবুর্চি ও সহকারী বাবুর্চি ছাড়া অন্য কোনো সাহায্যও দেয়া হয় না। হল প্রশাসন থেকে ভর্তুকি দেওয়া না হলে কোনো ভাবেই ডাইনিং চালানো সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক ড. কাউসার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “হলের ডাইনিং চালুর জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। রমজানে চালুর জন্য কয়েক জনের সাথে আলোচনা ও করেছি। তারা দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে এখনো জানায়নি। আগে শিক্ষার্থীরাই চালাতো। দ্রব্য মূল্যের উচ্চ মূল্যের জন্যে তারাও চালাতে পারছে না। এখন বাইরের কাউকে দিয়ে চালানো যায় কিনা সে চেষ্টা ও করা হচ্ছে।” প্রশাসন থেকে ভর্তুকি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে চালানো যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান -“সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয় না।তারপরেও আমি স্যারের সাথে আলোচনা করেছি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।তবে আমরা ডাইনিং চালুর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।”
এদিকে, আব্দুল মালেক উকিল হলের একাধিক শীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, হলের ডাইনিং এ খাবার রান্না হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তাছাড়া ডাইনিং এ যেতে সামান্য দেরি হলেই খাবার পাওয়া যায় না। প্রায়ই খাবারের মধ্যে পোকামাকড়সহ কাঁকড়া পাওয়ার ঘটনা ঘটে। তাছাড়াও ডাইনিং এ খাবারের মূল্য নিয়েও ছাত্রদের অসন্তোষ রয়েছে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং এ ৪৫ টাকার মধ্যেই মানসম্মত খাবার মিলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ডিমভাত ৩০ টাকা, মাছ-ভাত ৪৫ টাকা , মুরগী-ভাত ৪৫ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে নোবিপ্রবির মালেক উকিল হলের ক্যান্টিনে ডিম-ভাত ৫০ টাকা, মাছ-ভাত ৬৫ টাকা, মুরগি-ভাত এর জন্য ৬০ টাকা গুনতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
নিজের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে আব্দুল মালেক উকিল হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার কারণে নিয়মিত ভুগতে হচ্ছে আমাদের। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং গুলোতে যেখানে সহনীয় মূল্যে বেশ ভালো মানের খাবার সরবরাহ করা হয়, সেখানে আমাদের ডাইনিং অতিরিক্ত লাভের আশায় কম খাবার রান্না করা হয়। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?”
এ বিষয়ে নোবিপ্রবির আব্দুল মালেক উকিল হলের ক্যান্টিন ম্যানেজারের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। আব্দুল মালেক উকিল হলে খাবারের স্বল্পতা নিয়ে হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান রুবেল কে জিজ্ঞেস করলে জানান- “শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এখনো এমন কোনো অভিযোগ পাইনি। এ বিষয়ে আমি অবগত না। ক্যান্টিন এ কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে আজও আমি খোঁজ নিয়েছি। তেমন কিছু পায়নি। ” খাবারের উচ্চ মূল্যের বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা তো ক্যান্টিন । আর ক্যন্টিনে ডাইনিং এর মতো কোনো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। বাবুর্চি, হাঁড়ি পাতিল,গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল সব ই মালিক কে বহন করতে হয়।আর নোয়াখালী তে এমনিতেও শাক সবজি উৎপাদন কম যার জন্য অন্য জেলা থেকে সবকিছু আনতে হয়। ফলে সবকিছুর দাম ই বেশি। খাবারের দাম যে শুধু মালেক হলেই বেশি তা নই ।অন্য হল গুলোতেও প্রায় একই। পাশাপাশি বাইরের টং বিস্তা দোকানগুলোতে শিক্ষার্থীদের আরও অনেক বেশি দামে খাবার খেতে হয়”।
নোবিপ্রবিতে মেয়েদের হলগুলোতে খাবারের দাম তুলনামূলক কম হলেও মান অনেক নিম্ন বলে অভিযোগ বিবি খাদিজা হল, বঙ্গবন্ধু হল ও বঙ্গমাতা হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের। এমনকি ডাইনিং এর কিছু কিছু কর্মচারিদের ব্যবহারও অসন্তোষজনক বলে জানান তাঁরা। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা হলের এক শিক্ষার্থী খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করে বলেন -” খাবারের মান একেবারেই অনুন্নত। এখানের ব্যবসায়ীরা এক বেলার খাবার থেকে গেলে সেটা অন্য বেলায় ব্যবহার করে ফেলে। তার জন্য শিক্ষার্থীদের বাসি পাঁচা খাবার খেতে হয়। তাছাড়া খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মসলা ব্যবহার না করাই খাবারের স্বাদ ভাল হয় না।” তিনি আরো অভিযোগ করেন ডাইনিং এর জগ, গ্লাস গুলো প্রতিদিন পরিস্কার না করে দিনের পর দিন অপরিষ্কার পাত্রে শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো হচ্ছে ।
অভিযোগের ভিত্তিতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান জানান-” ডাইনিং ব্যবসায়ী খাবারের দাম বাড়িয়ে মান বাড়াতে চায়। কিন্তু খাবারের দাম বাড়ালে আবার শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে চায় না। এজন্যই সমন্বয় টা হচ্ছে না। আর মেয়েদের হলে গ্যাস লাইন ও চুলার ব্যবস্থা থাকায় এক তৃতীয়াংশ মেয়ে ই নিজে রান্না করে খায়। ফলে ডাইনিং তুলনামূলক কম মেয়ে খেতে আসে। ফলে ডাইনিং ব্যবসায়ীদের লাভ কম হয়।” বাসি খাবারের বিষয়ে তিনি বলেন “আমি অভিযোগ পেয়েছি বাসি খাবার নিয়ে। আমাদের চুক্তি তে এটা নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে আমি ওয়ারনিং দিয়েছি যেন আর না করা হয়। আমি চালের মানও পরিক্ষা করে দেখেছি। দেখে মান নিশ্চিত করতে বলেছি।”
তিনি আরো বলেন, দাম ও মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে আমরা কিছুদিন পরেই ওপেন টেন্ডারিং এ যাবো। আশা করা যায় এমন কাউকে পাবো যে কম দামেই মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে পারবে। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা এক শিক্ষার্থীর সথে কথা বলে জানা গেছে ক্যাম্পাসে দুপুরে একবেলা খেতে গেলে ১০০ টাকার নিচে খাওয়া যায় না। হলগুলোতে খবারের মান ভালো না।যে ক্যাফেটেরিয়া আছে সাধারণত শিক্ষার্থীরা সেখানে যায় না। কারণ সেখানে খাবারের মান ও ভালো না আবার দাম ও বেশি। ক্যাম্পাসে আশেপাশের খাবার দোকানগুলোতে খাবারের মান মোটামুটি ভালো হলেও দাম এত বেশি যে শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকদিন তা বহন করা কষ্টকর।
বঙ্গবন্ধু হল ক্যান্টিন বন্ধ প্রসঙ্গে হল প্রভোস্ট ড. অবন্তি বড়ুয়া এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন – নানান সমস্যার কারণে হলের ক্যান্টিন চালু করা যাচ্ছে না। আমি চালু করার জন্য আজ সকালেও কথা বলেছি। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের জন্য অনেকেই বাড়িতে।অনেকেই রান্না করে খায়। অল্প মানুষের জন্য ডাইনিং চালিয়ে ডাইনিং ম্যানেজারে লাভ হয়না। আবার দাম বাড়াতে চাইলেও শিক্ষার্থীরা মানতে চায় না। আমরা আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করেছি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ক্যান্টিন চালু করার। তিনি আরো বলেন – আমাদের হলের ফেসবুক পেজ এ বলা হয়েছে কারো খাবার লাগলে যেন হল অফিসে যোগাযোগ করা হয়। তাহলে খাবার এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু কেও এখনো যোগাযোগ করেনি।
নিয়মিত অপুষ্টির বা বাসি পাঁচা খাবার খেলে শিক্ষার্থীদের কী কী ক্ষতি হতে পারে এ বিষয়ে নোবিপ্রবি মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. ইশমাত আরা পারভীন বলেন – “পুষ্টিকর খাবার না খেলে শারীরিক, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে সমস্যা হয়। তাছাড়া রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।চুলপড়া সহ নানা সমস্যায়ও ভুগতে হবে।” তিনি আরো বলেন – পঁচা বাসি খাবার থেকে ডাইরিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া সহ নানা রোকম জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।