সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধ, সোয়াট ও বিজিবি মোতায়েন

আগের সংবাদ

জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় খালাস পেলেন শফিক রেহমান

পরের সংবাদ

চাঁদাবাজিতে জড়িত রেলওয়ে আরএনবি

চট্টগ্রাম এসআরভি স্টেশন এখন রীতিমত ট্রাক টার্মিনাল

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২৫ , ১২:১২ অপরাহ্ণ আপডেট: মে ২৭, ২০২৫ , ১২:১২ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীর স্ট্যান্ড রোড ভিক্টোরিয়া (এসআরভি) রেল স্টেশনের চারপাশ ঘিরে দুই পরিবহন নেতার প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ। তবে এই চাঁদার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রেলের কর্মকর্তারা। তবে সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রশ্নের জবাব দিতে কর্মকর্তারা একে অপরের কাছে চিঠি চালাচালি করে ডকেট ভুক্ত করে থাকে।

গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান ও সাংবাদিকের সরেজমিন প্রতিবেদন কালে এক কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তার কাঁধে দোষ চাপাতে ব্যস্থ থাকেন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তিন দফতরের শীর্ষ কর্তারা অবৈধ দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন চট্টগ্রামের এসআরভি স্টেশনের ইয়ার্ড এবং এর ৩ নম্বর লাইনের পাশে রেলের জমিতে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের অবৈধ পার্কিং করে দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে বেসরকারি পরিবহন সংস্থার লোকজন। এছাড়া স্টেশনের অভিমুখ সড়কের দুই পাশে প্রচুর পরিমানের অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।

রেলের সূত্র ধরে সবুজ বাংলার প্রতিবেদক সরেজমিন স্টেশনটিতে যায়। পরিচয় গোপন করে কথা হয় স্টেশনে গড়ে উঠা দুই গ্যারেজ মালিকের সাথে। এই আলাপকালে উঠে আসে এসআরভি স্টেশন কেন্দ্রিক রেল কর্মকর্তা ও পরিবহন নেতাদের মাসে লাখ টাকার চাঁদাবাজির চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্টেশনে রেল লাইন ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি গ্যারেজ যার একটির মালিক পরিবহন নেতা অরুণ বাবু অপরটির অনিল বাবু। এই গ্যারেজ গুলোতে ৫শ এর বেশি ট্রাক কাভার্ড ভ্যান পার্কিং এবং মেরামত করার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এখানে গাড়ি রাখতে হলে মাসিক চুক্তি করতে হয়। শুধু পার্কিং এর জন্য মাসে দিতে হয় ১৫০০ টাকা করে আর পার্কিং এর সাথে গাড়ির মেরামতের কাজ করানোর চুক্তি হলে মালিকদের গুণতে হয় গাড়ি প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে।

আবার মাসে না করে একদিনের জন্য গাড়ি রাখতে দিতে হবে ২০০ টাকার চাঁদা। ৫০০ ট্রাকের জন্য গাড়ি প্রতি ২ হাজার টাকা করে মাসে ১০ লাখ টাকা, বছরে এক কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয় অঘোষিত এই ট্রাক টার্মিনালে। কোটি টাকার চাঁদাবাজির সিংহ ভাগই চলে যায় রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পকেটে। তাই স্টেশন আঙিনায় এমন অবৈধ পার্কিং করলেও কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না ট্রাক মালিকদের। এমনটাই জানিয়েছেন গ্যারেজের থাকা নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক।

অভিযোগ রয়েছে এই ষ্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পোষ্টিং হাবিলদার, পংকজ রায়ের বিরুদ্ধেও। তিনি ষ্টেশনের আশেপাশে ১২ থেকে ১৫টা গ্যারেজ থেকে প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, ষ্টেশনের সাথে গোডাউনও ভাড়া দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পংকজ রায় রেলওয়ে ষ্টেশনের জেনারেল শাখায় পোষ্টিং হাবিলদার থাকাকালীন সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারের রাউজানের এমপি ফজলে করিমের প্রভাব খাটিয়ে ও হুমকি ধুমকি দিতেন অন্য সহকর্মীদের, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছেন পোষ্টিং হাবিলদারের পদও। এছাড়া সরকার পতন হওয়ার সাথে সাথে তিনি নিজেকে আড়াল করতে পছন্দের জায়গাটি এসআরবি ষ্টেশন বেছে নেন।

সেখানে গিয়েও তিনি মাদকের স্পট, ও নানা ধরনের অপকর্ম ও চোর চক্রের সাথে জড়িত হওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়। তার সাথে আছেন সিপাহী সুজন দত্ত, তিনি বাংলাবাজার ঘাটসহ আশেপাশের দোকান থেকে প্রতিমাসে চাঁদা তোলার অভিযোগ পাওয়া যায়। সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসলে পংকজ রায় ও সিপাহী সুজন দত্ত আগে থেকেই এই খবরটি সংশ্লিষ্ট ট্রাক চালকদের কাছে পৌঁছে দেয় বলে জানায় যায়। ফলেই ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের সুবিধাজনক ভাবেই গাড়িগুলো সরিয়ে নিয়ে থাকেন।

রেলওয়ে এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের ১২ নম্বর ধারা মোতাবেক রেল লাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে এলাকার মধ্যে রেলের কর্মী ছাড়া অন্যকারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এমনকি এর মধ্যে গরু ছাগল ঢুকে পড়লে সেটিকেও নিলামে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

ওই সীমানার ভেতরে কাউকে পাওয়া গেলে আইনের ১০১ ধারায় যে কাউকে গ্রেফতার করা যায়। এমন কঠোর আইন থাকার পরও এসআরভি স্টেশনে রেল লাইনের উপরেই ট্রাক, কাভার্ডভ্যান রাখা হলেও এর বিরুদ্ধে কোন স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের।

চুরি, মাদক স্পট ও স্টেশনের ভেতর ট্রাক টার্মিনাল থেকে টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হাবিলদার পংকজ রায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি ভাই চুরির সাথে জড়িত না, চাঁদা ও নিই না কারো কাছ থেকে। আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, দেখেন আমি বিভিন্ন দপ্তরে ভাউন্ডারী ওয়াল নিমার্ণ সহ বিভিন্ন সমস্যার জন্য চিঠি দিয়েছি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।

জানা যায়, গত বছর রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এই স্টেশনের আশপাশে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তার আচর পরেনি স্টেশন আঙিনায় থাকা এই ট্রাক টার্মিনালের দিকে। এদিকে অবৈধ স্থাপনা কিছু উচ্ছেদ হলেও প্রকৌশল বিভাগ ও স্টেশন মাস্টারের অবহেলায় তা পুনরায় দখল হয়ে গেছে। জানা যায়, বর্তমানে এই স্টেশনে একজন করে ষ্টেশন মাস্টার, পয়েন্টস ম্যান ও গার্ড আছে কাগজে কলমে, কিন্তু কেউ এখানে কাজ করেন না বলে জানা যায়। এছাড়াও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন হাবিলদার ও ২ জন সদস্য রয়েছে।

অথচ স্টেশন মাস্টারদের জিএস রুল এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আইন বলে অবৈধ দখলের দায়ভার তারা এড়াতে পারে না। এদিকে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন চিঠি অগ্রবর্তী করে উচ্ছেদের জন্য আমরা ভূ-সম্পদ বিভাগকে দিয়েছি। এ বিষয়ে রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চ্যাংগা বলেন, রেলের জায়গা দখল করে চাঁদাবাজি করার সুযোগ নেই। আমি যোগদান দেয়ার পর থেকে বহু ভূমি উদ্ধার করে রেলের নিয়ন্ত্রনে নিতে সফল হয়েছি। এসআরভি স্টেশনটি বন্দর কেন্দ্রিক হওয়ায় এটি চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেশন। আমি গুরুত্বের সাথে বিষয়টি দেখবো এবং পর্যায়ক্রমে স্টেশনটির আশপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবো।

এ বিষয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) চীফ কমান্ডেন্ট (পূর্ব) আশাবুল ইসলাম কে গতকাল এবং আজকে একাধিকবার ফোন করেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা রেলওয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) শাকিলা সোলতানা বলেন, আমি এই বিষয়টি নিয়ে খোজ খবর নেয়ার চেষ্টা করব। যদি এটি রেল পুলিশের এখতিয়ারভূক্ত এলাকায় পরে তাহলে দ্রুত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিবো। চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্ম বিষয় নিয়ে সিআই আবু সুফিয়ান কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পংকজ রায় ও সুজন দত্তের ব্যাপারে আমি খোজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবো শীঘ্রই।

উল্লেখ্য, এসআরভি স্টেশনটি রেলওয়ের পুরানো স্টেশনগুলোর অন্যতম। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এ স্টেশনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চলত। আমদানিকৃত পাথর, খাদ্যপণ্য, সার, ভারী মূলধনি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বন্দর থেকে খালাসের পর এসআরভি স্টেশনে বোঝাই হয়ে গন্তেব্য পৌঁছে। রেল অবকাঠামো নির্মাণের ভারী কাঁচামালও এ স্টেশনেই লোডিং-আনলোডিং হতো। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছের স্টেশন হওয়ায় আমদানিকারকরাও এসআরভি স্টেশনে মালপত্র বোঝাইয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। বর্তমানে এটি অকার্য্যকর অবস্থায় রয়েছে তবে স্টেশনটি সচল থাকলে পণ্যের পরিমাণ ও সরকারের রাজস্ব আয় আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়