দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর চলতি বছরেও তিন মিলিয়ন (৩০ লাখ) ক্লাবে অবস্থান করে নিয়েছে। ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার পরিবহন করায় পঞ্চমবারের মতো সেখানে জায়গা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কনটেইনার পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আমদানি-রপ্তানি বাড়ায় এ অবস্থান পোক্ত হচ্ছে দিন দিন। যদিও ২০২০ সালে ৫৮তম অবস্থান নিয়ে কভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গতি হারিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। তবে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে স্ক্যানার স্থাপন এবং বে-টার্মিনাল চালু হলে গতি আরো বাড়বে।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করেছে ৩০ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৭ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুভিলেন্ট ইউনিট)। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬২, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৬, মার্চে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৭৪, এপ্রিলে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৯, মে মাসে ৩ লাখ ১৯৩, জুনে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭৩, জুলাইয়ে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৫, আগস্টে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৯, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৪, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৯ এবং নভেম্বরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৮, টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়েছে। এছাড়া ডিসেম্বরের ১৫ দিনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়েছে ৫১ হাজার ৪৬৩ টিইইউ। ডিসেম্বর মাসের পরিসংখ্যানে গড়ে সাড়ে ৩ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে এ বছর হবে ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৪৬০ টিইইউ। বন্দরের পরিবহন শাখার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ টিইইউ, ২০২২ সালে ৩১ লাখ ৪২ হাজার, ২০২১ সালে ৩২ লাখ ১৪ হাজার, ২০২০ সালে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭, ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৭ এবং ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করায় ২০১৯ সালে প্রথমবার তিন মিলিয়নের ক্লাবে অবস্থান হয়। পরের বছর কভিড শুরু হওয়ায় সারাবিশ্বের মতো কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কমে গেলে তিন মিলিয়নের ক্লাব থেকে ছিটকে পড়ে। এরপর ধারাবাহিকভাবে তিন মিলিয়নের ক্লাবে অবস্থান শক্ত রাখতে সক্ষম হয় চট্টগ্রাম বন্দর। পর্যালোচনায় দেখা যায়, কনটেইনার পরিবহনকে মানদন্ড বিবেচনা করে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে থাকা ১০টি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের পোর্ট অব সিঙ্গাপুর, সপ্তমে দক্ষিণ কোরিয়ার পোর্ট অব বুসান, নবমে আরব আমিরাতের দুবাইয়ের জেবেদ আলী পোর্ট ছাড়া বাকী সাত বন্দরই চীনের। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের মুন্দ্রা পোর্ট ২৪ তম এবং জহরলাল নেহেরু ২৮ তম অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ তম অবস্থানে শ্রীলঙ্কার কলোম্বো পোর্ট এগিয়ে রয়েছে ৬৭ নম্বরে থাকা ১৩৭ বছরের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।
কনটেইনার হ্যান্ডেলিং প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী টার্মিনাল ম্যাানেজার (কন্ট্রোল) রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের ইকুইপমেন্ট ফ্যাসিলিটি অনেক বাড়ানো হয়েছে। এতে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের গতিও বেড়েছে। আমরা এবার ডিসেম্বরের অর্ধেকেই ৩০ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৭
টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করেছি। গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়। সে হিসাবে আমরা এবার ২০২২ সালের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের রেকর্ড ভাঙতে পারবো বলে আশা করছি। ‘লয়েডস লিস্ট’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৃথিবীর সকল ব্যস্ত পোর্টের যে তালিকা সেখানে আমরা কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কিছুটা কম করলেও ২০২০ সালে ৫৮ হয়েছিলাম। এর আগে বা পরে আমরা ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছি। তাই লয়েডস লিস্টের অবস্থান নির্ধারণ হয় যে পোর্ট কত ব্যস্ত, তার ভিত্তিতে। কভিড পরবর্তী আমাদের দেশের আমদানি-রপ্তানির গতি অন্য দেশের তুলনায় কমেছে বা আমরা একই অবস্থায় আছি। একইভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং এবারের জুলাই বিপ্লবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশের বাণিজ্যে কিছুটা হলেও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে কিছু না আগালেও আগের অবস্থানে থাকবে বলে আশা করে।
’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টেস এসোসিয়েশনের সভাপতি ও এবিসি শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের পারফরমেন্স অনেকটা ভালো হয়েছে। পারফরমেন্স আরও বাড়বে যদি তিনটি কাজ করে। প্রথমটি হলো কনটেইনার খালাস কার্যক্রম বাইরে নিয়ে যাওয়া। এজন্য সহজ শর্তে অফডক বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয় হলো পতেঙ্গা কনটিইনার টার্মিনালে স্ক্যানার বসানো। শুনেছি, ফেব্রুয়ারিতে স্ক্যানার বসানো হবে। এখনতো শুধু এক্সপোর্ট হয়। স্ক্যানার বসালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং আরও বাড়বে। আর সবশেষ হলো বে-টার্মিনাল। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বে-টার্মিনাল করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বন্দর হবে।’এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বেড়েছে কারণ দেশে ট্রেড হয়েছে। ট্রেড হলে অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাড়লে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং স্বাভাবিকভাবে বাড়বে। দেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে সেই দেশের বন্দরের পারর্ফম্যান্স কী। বন্দরের কাজ হচ্ছে ফ্যাসিলিটি দেওয়া। ফ্যাসিলিটি অনেকদিকে বাড়ানো হয়েছে।
তবে গত কয়েক বছর ধরে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে আমরা যে কাছাকাছি অবস্থানে ঘুরছি। এজন্য ট্রেড বাড়ানো প্রয়োজন। আর আগামীতে ট্রেড ফ্যাসিলিটি আরও বাড়ানোর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের ভিতরে পণ্য খালাস প্রক্রিয়া না রাখার কথা ভাবছে। পণ্য খালাস প্রক্রিয়া বন্দরের বাইরে চলে গেলে জাহাজের ওয়েটিং টাইম ও স্টে টাইম কম লাগবে। সেক্ষেত্রে আরও জাহাজ ভিড়বে এবং কনটেইনার হ্যান্ডেলিং মাত্রা বাড়বে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।