বরখাস্তের পর পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা
চট্টগ্রামের গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের (সিজিপিওয়াই) স্টেশনে তেল চুরির ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) চার সদস্য। তবে তাদের বরখাস্ত করলেও চুরির ঘটনা পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম)।
রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরখাস্ত হওয়া চার সদস্যকে ‘বাঁচাতেই’ পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ডিআরএম এবিএম কামরুজ্জামান জানান, নিরাপরাধ ব্যক্তি যাতে শাস্তি না পায়, সেজন্য ‘আরও তথ্য জানতে’ পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোববার (১০ নভেম্বর) সিজিপিওয়াইয়ে তেল চুরির ঘটনায় চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বরখাস্ত হওয়ায় চার আরএনবি সদস্য হলেন হাবিলদার আমিনুল হক এবং সিপাহি মাহমুদুল হাসান, শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসার।
জানা গেছে, ২৬ অক্টোবর সিজিপিওয়াইয়ে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। এটি ধামাচাপা দিতে অপর পাঁচ নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মূলহোতা সিপাহি মাহমুদুল হাসান সরকারের রেলপথ উপদেষ্টার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ক্ষুদেবার্তা পাঠান। এরপর ২৮ অক্টোবর ১২ জনকে তলব করলে সেখান থেকে ছয় জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেলওয়ে। কিন্তু তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ‘থলের বিড়াল’।
তদন্ত কমিটি জানায়, উপদেষ্টাকে অভিযোগ দেওয়া সেই মাহমুদুল হাসানসহ চার আরএনবি সদস্যই তেল চোর। তারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসিয়েছেন। এক মাসে ১৬ বার তেল চুরি
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২৬ অক্টোবর বন্দর এলাকার সল্টগোলা মহেশখাল ব্রিজ এলাকায় রেলওয়ে ওয়াগন থেকে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রেলের অস্থায়ী কর্মচারী আবু তাহের, আরএনবির নায়েক ইয়াসির আরাফাত, হাবিলদার জসিম উদ্দিন সরকার, সিপাহী বাবলু মিয়া, ট্রেনচালক মাইদুল ইসলাম, সহকারী ট্রেন চালক গোলাম সরওয়ারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাদের বরখাস্তের পর গুঞ্জন ওঠে, শাস্তি পাওয়া ব্যক্তিরা সেদিনের ঘটনায় জড়িত ছিলেন না।
সিসিটিভির ১৬টি ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসে ১৬ বার তেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিবারই তেল চুরিতে ছিলেন আরএনবির হাবিলদার আমিনুল হক, সিপাহি মাহমুদুল হাসান, শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসার।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ২৬ অক্টোবর ভোর ৫টা ২০ মিনিটে একটি ওয়াগন থেকে ওই চার জনের চক্র তেল চুরির পর গ্যালন হাতে নিয়ে নারিকেল গাছের পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন।
এসব ঘটনার পর ২৭ অক্টোবর ইয়ার্ড মাস্টার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সিজিপিওয়াইয়ের ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর আবু সুফিয়ানকে লিখিতভাবে জানান।
এ ঘটনায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। এর আগে অন্তর্র্বতী সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তেল চুরির ঘটনা নিয়ে একটি ক্ষুদেবার্তা দেন সিপাহি মাহমুদুল। উপদেষ্টা ফাওজুল ও সিপাহি মাহমুদুলের বাড়ি সন্ধীপে একই এলাকায়।
ক্ষুদেবার্তায় অভিযোগ করে মাহমুদুল লেখেন, ‘২৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৩টার দিকে ডিউটি শেষে তিনি ছাড়াও হাবিলদার আমিনুল হক, সিপাহি শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসার চা-নাশতা খেতে সল্টগোলা এলাকায় যান। সেখানে অবস্থান করা একটি তেলের ওয়াগন থেকে তেল চুরি হচ্ছে বলে তাদের সন্দেহ হয়। এ সময় তারা দুজনকে হাতেনাতে ধরেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরএনবির সিজিপিওয়াইয়ের পোস্টিং হাবিলদার জসিম উদ্দিন, নায়েক মো. ইয়াসিন, সিপাহি বাবলু, সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক, নিউমুরিং ইয়ার্ড ইনচার্জ মৃণাল কান্তি দাশ ও পয়েন্টসম্যান আবু তাহেরের হয়ে তারা তেল চুরি করেন বলে জানান। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ওই দুই ব্যক্তির লোকজন হামলা করে তাদের ছিনিয়ে নিয়ে যান। হামলায় আহত হয়েছেন বলে ক্ষুদেবার্তায় দাবি করেন মাহমুদুল হাসান। পরে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটি উপদেষ্টা রেলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠালে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই বার্তার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই তিন আরএনবি সদস্যসহ ছয় জনকে বরখাস্ত করা হয়।
জানা গেছে, সিপাহি মাহমুদুল হাসান ৯ বছর ও সিপাহি শহীদুল সিজিপিওয়াইয়ে আছেন ১৪ বছর ধরে। এর মধ্যে তাদের সিআরবিতে বদলি করা হলেও একবছর পর আবারও সিজিপিওয়াইয়ে ফিরে আসেন। রেলওয়ের তেলবাহী এসব ওয়াগন স্টেশন মাস্টার আবদুল মালেক, শান্টিং কর্মচারী চালক ও সহকারী চালকের তদারকি থাকার কথা। কিন্তু তাদের গাফেলতিতেই এমন চুরির ঘটনা ঘটছে। এসব কাজে তারা জড়িত রয়েছে বলেও অভিযোগের আল ওঠেছে।
আরএনবির একটি সূত্রে জানা গেছে, ২৬ অক্টোবরের তেল চুরির ঘটনার সময় দায়িত্বে ছিলেন আরএনবি চট্টগ্রাম গোয়েন্দা শাখার সিপাহি মকসুদ ও নজরুল কবির। তেল চুরির ঘটনায় তারাও জড়িত ছিলেন। বিষয়টি জানতেন গোয়েন্দা শাখার ইন্সপেক্টর ইয়াসিন উল্লাহ। কিন্তু এরপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আরও জানা গেছে, চুরি করা এসব তেল সাজ্জাদ ওরফে তেল সাজ্জাদ নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। তার সঙ্গে রেলের চোর চক্রের প্রায় সবার সঙ্গেই বেশ সখ্যতা রয়েছে। সাজ্জাদ সল্টগোলা এলাকায় ব্যবসা করেন।
এছাড়া গ্যালনে করে তেল চুরির পর প্রতিটি ওয়াগন ঢাকার পৌঁছলে সেখান থেকে প্রায় ২০০ লিটার তেল খালাস না করে আবার চট্টগ্রামে ফেরত আনা হয়। পরে এসব তেল বিক্রি করে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় চোর চক্র।
পূর্বাঞ্চলের ডিআরএম এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘চুরিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আরও তথ্য জানতে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি না পায়।’
তদন্ত কমিটির প্রধান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যারা সেদিন চুরিতে জড়িত ছিলেন, তারাই উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে অভিযোগ করেছিলেন।
অভিযুক্ত চার জন তেল চুরিতে জড়িত তদন্তে এমন তথ্য ওঠে এসেছে। আমরা তাদের অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’
আরএনবির চট্টগ্রামের কমান্ড্যান্ট মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘কয়েকজন সদস্যের কারণে বাহিনীর দুর্নাম হচ্ছে। তদন্তে বেরিয়ে এলো, অভিযোগকারীরাই তেল চুরিতে জড়িত। চুরিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বিভাগীয় নেওয়া হচ্ছে।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।