বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমাদের যে রাস্তা-ঘাটগুলো ছিল সে রাস্তাঘাটে অমুক দল তমুক জল ছিল না। কিন্তু আপনি যদি এখন রাস্তায় বের হন, দেখবেন দেয়াল পোস্টারে ছেপে গিয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের সময়ে যেভাবে পোস্টার ছিল ঠিক একইভাবে পোস্টার ছাপানো হয়েছে। শুধু ছবিগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। আপনাদেরকে বলতে চাই ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে আপনারা সেই আন্দোলনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করবেন না।
দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রদের যে আন্দোলনটি হয়েছিল সেই আন্দোলনটি হয়েছিল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে, টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে। টেন্ডারবাজ এবং দুর্নীতিবাজ যারা রয়েছে আপনাদের সতর্ক করতে চাই। আপনারা ১৬ বছর একটি দলের ছত্রছায়ায় ছিলেন। এখন যদি আর একটা দলের ছত্রছায়ায় এসে আপনারা দুর্নীতি করার চেষ্টা করেন ছাত্র জনতা আপনাদেরকে দেখে নিবে।
আজ রবিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরের লালদিঘী ময়দানে গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-নাগরিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি ঢাকাতে যখন আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো তখন চট্টগ্রাম থেকে আপনারা আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আমরা দেখেছি ওয়াসিমরা কিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, শান্তরা কিভাবে রক্ত দিয়েছে।
আমরা সেই চট্টগ্রামে এসেছি। আমরা আপনাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চাই, সংকটকালীন সময়ে আমরা যেভাবে একসাথে হয়েছিলাম এখন দেশটা পুনর্গঠনের সময়। আমাদেরকে একইভাবে একসাথে থাকতে হবে।
হাসনাত বলেন, বীর চট্টলাবাসী সবসময় ধর্মভিরু। কিন্তু আমরা দেখেছি তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবসময় ধর্মীয় গোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দাঁড়ি-টুপি যাদের রয়েছে তাদেরকে সবসময় প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, যে দাঁড়ি-টুপির মানুষগুলো সেদিন উত্তরায় নেমে এসেছিল, যাত্রাবাড়িতে দুর্গ গড়ে তুলেছিল তাদের সমন্বয়কের পরিচয় লাগেনি। উত্তরায় যারা শহীদ হয়েছিল তাদের সমন্বয়কের পরিচয় লাগেনি। ঠিক একইভাবে এ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে আমাদের সমন্বয়ক হওয়ার প্রয়োজন নেই, সহ সমন্বয়ক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে যারা রয়েছে প্রত্যেকেই সমন্বয়ক, প্রত্যেকেই সহ সমন্বয়ক।
কেন্দ্রীয় এই সমন্বয়ক বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই এই ছাত্র নাগরিকদের পাওয়ার কিছুই নেই, আমরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত। আমাদের ছাত্র নাগরিক রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, পুলিশের সামনে বুক পেতে দেয়। যে চাঁদাবাজ এবং টেন্ডারবাজ রয়েছেন, আপনাদেরকে বলতে চাই; আমরা বুলেট-বোমা ভয় পাই না। আপনারা সতর্ক হয়ে যান। আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে পুঁজি করে আপনারা যদি ভেবে থাকেন আবার দুর্নীতি শুরু করবেন তবে ছাত্র-নাগরিক আপনাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলবে।
প্রশাসনে কর্মরতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করুন। আপনারা যদি ভেবে থাকেন আপনারা গোস্সা করে বসে থাকবেন, অফিস-আদালতের কাজ করবেন না; তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন। এই আন্দোলনে কামার ছিল, কুলি ছিল, মুচি ছিল। ঠিক একইভাবে এই আন্দোলনে শিক্ষিত শ্রেণিও ছিল। সুতরাং আপনাদের রিপ্লেসমেন্টও হয়ে যাবে।
পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ছাত্র এবং পুলিশ হচ্ছে ভাই-ভাই। আমাদের কোনো বিভেদ নাই। আপনারা আপনাদের কাজে ফিরে আসুন। আপনাদের মধ্যে যারা খুনিদের দোসর ছিল তাদেরকে আমরা জানি। সব পুলিশ কিন্তু বেনজির না। সব পুলিশ ডিবি হারুন না। আমার বাবা, আমার ভাই; তারাও কিন্তু পুলিশ। সুতরাং পুলিশদের আমরা সহযোগিতা করবো। রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে যারা বর্তমানে মাঠে রয়েছেন তাদেরকে আমরা প্রতিপক্ষ না ভেবে সহযোগী ভেবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাব। পুলিশদের প্রতি বার্তা—দেখেন বেনজীর দেশে থাকতে পারেনাই। ডিবি হারুন ভালো নেই। সুতরাং আপনারা জনমুখী না হয়ে ক্ষমতামুখী হলে আপনাদের অবস্থাও বেনজীর এবং হারুনের মতো হবে।
সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা সবাই জানি—চাঁটগাইয়া পোয়া, মাডিত পইল্লি লোয়া (চট্টগ্রামের ছেলে, মাটিতে পড়লে লোহা)। সুতরাং এই চিটাইঙ্গা পোয়াদেরকে আপনারা ভয় দেখাতে আইসেন না। আপনাদেরকে আবার সতর্ক করতে চাই, প্রভু চলে গিয়েছে কিন্তু প্রভুর দাসরা আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। তারা বিভিন্ন রুপে আমাদের মাঝে এসে আমাদের ইউনিটিকে ভাঙতে চাইবে। আপনাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যেভাবে আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থকে সামনে রেখে একসাথে কাজ করেছি একইভাবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে একসাথে কাজ করবো।
চট্টগ্রামে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো চেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদেরকে বিভাজন করেছে। বিভাজনের রাজনীতি বিদ্যমান রেখে তারা ফ্যাসিজম কায়েম করেছে। তারা সবসময় বিভাজন করেছে, কারা দাঁড়িওয়ালা কাদের দাঁড়ি নাই। কারা মাদরাসা শিক্ষার্থী, কারা না। কিন্তু এই ফ্যাসিজম পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা উদাহরণ তৈরি করেছি। মন্দিরে মন্দিরে যখন হামলা হয় তখন সেই মন্দির পাহাড়া দিয়েছে আমাদের দাঁড়ি-টুপিওয়ালা ভাইয়েরা। আমাদের সবার প্রথম পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। এরপর উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে হাত তুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি করান।
এসময় মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, সহ-সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিসহ অন্যান্যরা। এছাড়াও লালদিঘী মাঠ ছিল বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীতে পরিপূর্ণ। যোগ দিয়েছিলেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষও।
উল্লেখ্য, গতকাল শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দেন— তাদের একটি সমন্বয়ক টিম প্রত্যেকটি জেলার অভ্যুত্থান ঘটানো ছাত্র-জনতার সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম এসে সকাল ১১টায় ছাত্র-জনতার সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিকেল ৩টায় লালদিঘী ময়দানে মতবিনিময় সভা করেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
অপরদিকে, সমন্বয়ক সারজিস আলম বিভাগীয় সফরের প্রথম জেলা হিসেবে আজ বিকেল ৩টায় মুন্সিগঞ্জে মতবিনিময় সভা করেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।