কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৮জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে চারজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা পরিষদ বাজারে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের পর থেকে উপজেলা পরিষদ বাজার এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বিএনপির দুই পক্ষ একে অপরের বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন।
সংঘর্ষে আহত উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক জাফর ইকবাল কর্নেল অভিযোগ করেন, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে জেঁকে বসা অনিয়ম দুর্নীতির ব্যাপারে তারা প্রতিবাদ করে আসছিলেন। গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত দালাল সিন্ডিকেট এই সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি করতো। যুবদল নেতা কর্নেল বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুৎ হওয়ায় নতুন করে দেশ স্বাধীন হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। আর এখন সেই জায়গা দখল করে বিএনপির একটি পক্ষ চাঁদাবাজি করছেন। আমরা প্রতিবাদ করায় প্রতিপক্ষের লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করেছেন। তিনি বিএনপির উচ্চপর্যায়ে এ ঘটনায় সাংগঠনিক বিচার প্রার্থনা করেন।
এদিকে বুধবার রাত ১০টায় উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে বিএনপির অপর পক্ষ জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে পাল্টা অভিযোগ করেন। তারা পুরো ঘটনার জন্য উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক আকবর আলী ও তার ছেলে যুবদল নেতা জাফর ইকবাল কর্নেলসহ আরো কয়েকজনকে দায়ী করেন। এ সময় উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক শের আলী সবুজ লিখিত বক্তব্যে বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারা দেশের মতো দৌলতপুরের মানুষও ইতিবাচক সংস্কারের স্বপ্ন দেখছেন। দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ এলাকায় দুর্নীতি, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লার নির্দেশে সজাগ দৃষ্টি রেখে আসছেন স্থানীয় ছাত্র-জনতা। এ অবস্থার মাঝেই কিছু লোক বিএনপির নাম ভাঙিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন।
এর জেরে বুধবার বিএনপি নেতা আকবর আলীর ছেলে যুবদল নেতা জাফর ইকবাল কর্নেল ও তার লোকজন চাঁদার দাবিতে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে উপজেলা বাজারে আসেন। এ সময় স্থানীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর নাম উল্লেখ করে তারাও কর্নেলের সাথে ছিলেন বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। ঘটনার সময় স্থানীয় বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা তাদের চলে যেতে বললে তারা আকস্মিকভাবে কোমর থেকে পিস্তল, হাতুড়ি, হাত কুড়াল বের করেন। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় জনতা তাদের প্রতিহত করেন। এতে চাঁদাবাজ চক্রের কয়েকজন এবং স্থানীয় জনতার মধ্যে কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনার পর আহত যুবদল নেতা জাফর ইকবাল কর্নেল ফেসবুক লাইভে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্নের চেষ্টা করেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়।
বুধবারের সংঘর্ষে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক জাফর ইকবাল কর্নেল, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক রতন আহমেদ, দৌলতপুর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক কৌশিক আহমেদ, ছাত্রদল নেতা সোহেল পারভেজসহ অন্তত ৮জন আহত হন। তাদের মধ্যে চারজনকে দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। উপজেলা বিএনপির ছোট একটি অংশের নেতৃত্বে থাকা হাজি আলতাফ হোসেন আহতদের দেখতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান এবং সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক আকবর আলী ও তার ছেলে যুবদল নেতা জাফর ইকবাল কর্নেল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতাকে শেল্টার দেয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেছেন। বিএনপি নেতা আকবর আলী দৌলতপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গভীর সখ্য বজায় রেখে চলেছেন, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রেখেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আকবর আলীর গোপন আঁতাতের বিষয়টি উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা জেনে যাওয়ায় তিনি এখন আর আকবর আলীকে পাত্তা দিচ্ছেন না, তাকে এড়িয়ে চলছেন। এ কারণে উপজেলা বিএনপির কাণ্ডারি রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লার বিরোধীতায় নেমেছেন আকবর আলী। বাচ্চু মোল্লা সম্প্রতি উপজেলা বাজারে বিএনপির নতুন অফিস খুলেছেন। এর ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়া আকবর আলী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাজি আলতাফ হোসেনের গ্রুপে যোগ দেয়ার সব রকম বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক আকবর আলীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন খোলা পাওয়া যায়নি।
দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ বাজারে একটা মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ওদের চাচা-ভাতিজার মধ্যে পারিবারিক ঝামেলা ছিল। পারিবারিক ঝামেলার জেরে এটা ঘটেছে। তারা সবাই বিএনপি করেন। এখন তারা নিজেদের ভেতর ফ্যাসাদ বাদিয়ে রাজনৈতিক রং লাগানোর চেষ্টা করছেন।
রাতে দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান, উপজেলা এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এক পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনাগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে যুগ যুগ ধরে বাড়তি টাকা নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। সাব-রেজিস্ট্রার ও দালাল চক্রের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক প্রতি দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য ২৫০০ টাকা বেশি আদায় করা হয়। নামের ভুল থাকলে ঘুষ দিতে হয়। পরিচয়পত্র অনলাইন থেকে প্রিন্ট করাতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দিতে হয়। দলিলের দাম বেশি নেয়া হয় এবং প্রতিটি সেবার জন্য পদে পদে ঘুষ দিতে হয়।
প্রসঙ্গত, বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চাঁদাবাজি করে আসছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুৎ হওয়ার পর আওয়ামী সিন্ডিকেটের লোকজন এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে বিএনপির লোকজন সাব-রেজিস্ট্রার অফিস নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই অফিসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন স্থানীয়রা। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে দৌলতপুর থানার পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় উপজেলা বাজার এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।