খননকাজে ধীরগতির কারণে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি ও মৎস্য ঘের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্থ
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় ভৌগোলিকভাবে অবস্থান দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মরিচ্চাপ নদীর। এক সময়ের খরস্রোতা নদীটি কালের বিবর্তে হারিয়ে ফেলেছে তার যৌবন। পলি পড়ে ভরাট হতে হতে প্রাণহীন হয়ে গেছে। নদী ভরাটের কারণে এলাকাজুড়ে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে গত বছর থেকে সরকারি অর্থায়নে শুরু হয়েছে নদী পুনঃখননের কাজ। কিন্তু এ খননে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে এলাকাবাসী। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুনঃখননের ফলে নদীটি তার রূপ বদলে খালে রূপান্তরিত হচ্ছে। সে কারণেই স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি, এভাবে খনন করা হলে কোটি কোটি টাকার সরকারি অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু জনসাধারণ কোনো সুফল ভোগ করতে পারবে না। অপরদিকে, গত বছর খননকাজ চলমান থাকায় উপজেলার অনেক স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে ওই এলাকাগুলো ছিল অনাবাদি।
চলতি বছর মে মাসে কাজ শেষ করে নদী উন্মুক্ত করা না হলে আবারও পূর্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে দাবি স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধির। উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের ও মরিচ্চাপ নদী পাড়ের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম, আজিজুল ইসলাম ও আব্দুল হান্নান গাজীসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, মূল নদীর ৭৫ শতাংশ বাদ দিয়ে খনন করা হচ্ছে। তাছাড়া কোথাও কোথাও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন ইচ্ছামতো খনন করছে এমন অভিযোগ করে তারা আরও বলেন, নদীর মাঝ বরাবর বাদ দিয়ে স্থানীয়দের বাড়িঘর ও কবরস্থান ভেঙে দিয়ে খনন করা হচ্ছে। সে কারণে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এবিষয়ে আশাশুনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব এবিএম মোস্তাকিম বলেন, পাড় বাদে নদীর মূল অংশ ২০০ ফিট হবে। কোথাও কম হলে তা মেনে নেওয়া হবে না। আমার কাছে এখনো কেউ অভিযোগ করেনি। কোনো ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই সরেজমিনে গিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের এক ইঞ্চি জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সে কারণে নদী খননের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। এ বরাদ্দকৃত টাকার কোনো কাজ নিয়ে নয়-ছয় করার কোনো প্রকার অপচেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না। আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী বলেন, মরিচ্চাপ নদী পুনঃখননে ডিজাইন করার সময় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সুশীল সমাজকে বাদ রাখা হয়। ফলে খননে এখন নানা অনিয়ম ও ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নদীটি যে প্রস্থ ছিল খনন কাজে তার অধিকাংশ বাদ দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এক সময়ের খরস্রোতা মরিচ্চাপ নদীতে বড় লঞ্চ ও স্টিমার চলত।
তবে নদীটি পুনঃখননে অন্তত সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ৫০ শতাংশ প্রস্থ করে খনন করা হতো তাহলে অনেক উপকারে আসত। তিনি বলেন, মে মাসে সাধারণত আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় সে কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে খনন কাজ শেষ করতে হবে। গত বছর নদী পুনঃখননের কাজ চলমান থাকায় বড়দল ও খাজরা ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার বিঘা জমিতে আবাদ করা সম্ভব হয়নি। সে কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খনন কাজ শেষ করার তাগিদ দেন তিনি। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, আশাশুনি উপজেলা সদর দিয়ে বয়ে যাওয়া মরিচ্চাপ নদীর মধ্যচাপড়ার খোলপেটুয়া নদীর সংযোগ থেকে শুরু হয়ে উপজেলার তেঁতুলিয়া বেতনা নদী সংযোগ পর্যন্ত ৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
৬৪টি জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের অধীনে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। টেন্ডার অনুযায়ী প্রকল্পটির কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালী জেলার এমএ জেভি। যার কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর। ওই কার্যাদেশ অনুযায়ী চলতি বছরের ২০ জুনে শেষ কাজ করার কথা। পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে আরও জানা গেছে, সিএস রেকর্ড অনুযায়ী আশাশুনির মরিচ্চাপ নদী ৬০০ ফুট কোথাও ৫৫০ ফুট প্রস্থ ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির ডিজাইন অনুযায়ী মরিচ্চাপ নদী পুনঃখনন করা হচ্ছে ৯০ থেকে ১৮০ ফুট। যা গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই বাদ দিয়ে পুনঃখনন হচ্ছে। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএ জেভি’র স্বত্বাধিকারী অলিউল্লাহ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইন অনুযায়ী মরিচ্চাপ নদী পুনঃখনন করা হচ্ছে। এখানে ঠিকাদাদের কিছুই করার নেই।
এলাকার লোকজন পক্ষে-বিপক্ষে অভিযোগ বা কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নদীটি খনন কাজে কোনো অনিয়ম করা হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০ শতাংশ খনন সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী জুনেই কাজ শেষ হবে। এব্যাপারে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, মরিচ্চাপ নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে যে পরিমাণ পুনঃখনন করা দরকার সে অনুযায়ী প্রকল্পের ডিজাইন করা হয়েছে। তবে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নদীটির প্রস্থ কোথাও ৬০০ ফুট বা কোথাও ৫৫০ ফুট ছিল। একটি নদী পুনঃখনন করে পূর্বের স্থানে ফিরে আনা যায় না।
সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে খনন কাজ সঠিক সময়ে সিডিউল অনুযায়ী বুঝে দিতে হবে বলে জানান তিনি। কোথাও কোথাও নদী খননের সিডিউল অনুসর করা হচ্ছে না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করছেন, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এব্যাপারে আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রনি আলম নূর জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিডিউল ও ডিজাইন অনুযায়ী মরিচ্চাপ নদী পুনঃখনন করতে হবে। কোথাও কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থ নেওয়া হবে। তবে এখনো পর্যন্ত তার কাছে লিখিত কোনো অভিযোগ আসেনি বলে তিনি জানান।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।