টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের সামনের এক বস্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাম ফর রোড চাইল্ড শাখার শীত বস্ত্র বিতরণের টোকেন প্রদান করতে যায়।
টোকেন বিতরণের একপর্যায়ে বিএমবি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম একটি ঘরের মেঝের মধ্যে, ভাঙ্গা পা নিয়ে, ব্যথায় কাতরানো ইয়াসিন নামের এক শিশুকে দেখতে পান। বাচ্চাটির বয়স সাত বছর। মা-বাবা কেউ নেই। বাচ্চাটির মা মারা গেছেন চার মাস বয়সে, বাবা বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তাি জানেননা কেউ। বাচ্চাটির মা মারা যাওয়ার পরে সেলিম হোসেন বাচ্চাটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। তিনি পেশায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। অসহায় সেলিমেরও রয়েছেন এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্ত্রী, সেই স্ত্রীর সঙ্গে ইয়াসিন নামের এই শিশুটি ভিক্ষাবৃত্তিতে করতো বলেও জানিয়েছেন স্হানীয়রা।
জানা যায়, গত বছরের ১৩ ই ডিসেম্বর বাচ্চাটি একটি ড্রেনে পড়ে গিয়ে তার বাম পায়ের ফিমার মাঝ বরাবর ভেঙ্গে যায়। বাচ্চাটির পালিত বাবা সেলিম হোসেন তাকে চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু তিনি নিজেও একজন প্রতিবন্ধী হওয়ায় এবং চিকিৎসার ব্যায়ভার জানতে পারার পরে তিনি ঘাবড়ে যান। একপর্যায়ে তিনি বাচ্চাটির চিকিৎসা বন্ধ করে, বাচ্চাটি নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে চলে আসেন। গ্রামীণ পদ্ধতিতে বাচ্চাটির চিকিৎসা দিতে থাকেন, যার ফলশ্রুতিতে বাচ্চাটির পা ফুলে যায় এবং ঘা দেখা দেয়।
অত:পর ঘটনাটি শুনে কেঁদে ওঠে মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থী আরিফুলের মন। আরিফুল বাচ্চাটির এই অবস্থা দেখার পরে, জরুরি ভাবে বাচ্চাটির চিকিৎসার জন্য উদ্যোগ নেন। তখন ক্যাম্পাসে শীতকালীন ছুটি চলছিলো। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো থেকে তিনি কোন সহায়তা না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মানিক শীল কে বিষয়টি অবগত করেন।
আরিফুলকে ছাত্রলীগ সভাপতি মানিক শীল ও সহ সভাপতি মেহেদী হাসান খান নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন।
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আরিফুল বাচ্চাটিকে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে আউটডোরে ডাক্তার দেখান এবং ডাক্তারের কাছে জানতে পারেন তার অপারেশন প্রয়োজন। অপারেশনের টাকা ম্যানেজ করতে শিশুটিকে নিয়ে আরিফুল চলে যান টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) ওলিউজ্জামান বাচ্চাটিকে দেখে তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়।
আন্ডারট্রাকশন দেওয়ার সময় বাচ্চাটির রক্তের প্রয়োজন পড়ায় আরিফুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তদানের সংগঠন বাঁধনের সাৎে যোগাযোগ করেন। বাঁধনের বর্তমান সভাপতি বিজিই বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সাকিব নিজেই রক্তদানের জন্য এগিয়ে যায় এবং বাচ্চাটির পরবর্তী চিকিৎসাকালীন সকল কাজ করতে শুরু করেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে আরিফুল ও সাকিব একটি আবেদন করেন। সেখান থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা সহায়তা পান, এই টাকা দিয়ে তারা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং তারা অনুরোধ করেন বাচ্চাটির পুরো চিকিৎসার দায়িত্ব টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনকে নিতে। পরবর্তীতে টাঙ্গাইলেট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বাচ্চাটির চিকিৎসা সেবার যাবতীয় দায়িত্ব, হাসপাতাল সমাজসেবার কাছে হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয় এর অধীনে বাচ্চাটির চিকিৎসা চলতে থাকে।
চিকিৎসা শুরুর সপ্তম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফেরদৌস শান্ত ও বাচ্চাটির পাশে এসে দাঁড়ায়। আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে, বাচ্চাটির চিকিৎসা শেষ হওয়া পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তিনিও।
চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার খন্দকার সাদিকুর রহমান, হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক জনাব সৌরভ তালুকদার ও তার কর্মী নুরুল ইসলাম সাহায্য করে যান। এছাড়াও হাসপাতালে ইন্টার্নরত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়মা সুলতানা ও নার্স সাদিয়া চৌধুরী, আয়া শম্পা ও শিল্পী ব্যাপকভাবে চিকিৎসার সেবায় সহায়তা করে যান।
বাচ্চাটির এই চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএমবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এর প্রতিষ্ঠান ড. আশেকুল ইসলাম ফাউন্ডেশন ও সিআরসি ঢাকা ব্রাঞ্চের সভাপতি নাদিয়া কমনিচি আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ান এবং চিকিৎসার জন্য যাবতীয় খোঁজখবর নিয়ে যান।
বাচ্চাটির মা-বাবা কেউ পৃথিবীতে না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী আরিফুল, সাকিব ও শান্ত চিকিৎসা কালীন সময়ে বাচ্চাটিকে তিন বেলা খাবার খাওয়ানো, নখ কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে এমনকি মলমূত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজগুলো করে গেছেন। ক্যাম্পাস খোলার পরে যখন রেগুলার ক্লাস চালু হয় তখন তারা হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অনুরোধ করে বাচ্চাটির জন্য একজন আয়া নির্ধারণ করেন। শিল্পী নামের ওই আয়া ইয়াসিনের চিকিৎসার শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় সেবা যত্ন করে যান।
দুই মাস চিকিৎসার পরে বাচ্চাটি বর্তমানে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে হাঁটতে সক্ষম হয়েছে। বাচ্চাটি যেহেতু ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত ছিলেন তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেন এই বাচ্চাটিকে আর ওই পালিত বাবার কাছে না দেওয়ার জন্য। তারা হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) কে বিষয়টি অবগত করেন। সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে মাধ্যম করে বাচ্চাটিকে সরকারি শিশু পরিবার ( শান্তিকুঞ্জ এতিম খানা) তে ভর্তি করেন। বাচ্চাটি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এই শিশু পরিবারেই থাকবে।
বর্তমানে শিশুটি পড়াশোনা থেকে শুরু করে তার সকল মৌলিক চাহিদা পেয়ে যাচ্ছেন, সমাজসেবা কার্যালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান সরকারি শিশু পরিবার থেকে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।