স্মরণ
৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মোশাররফ হোসেনের ৫০তম হত্যা বার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গণপরিষদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্য মোশাররফ হোসেনকে ১৯৭৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা রাতে যশোর শহরের নিজ বাস ভবনে রাজনৈতিক দুর্বত্তরা হত্যা করে।
তিনি পড়াশোনা করেছেন যশোর জিলা স্কুলে, এরপর কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের( সাবেক রিপন কলেজ) আইনের ছাত্র ছিলেন। জন্ম বনগাঁর সবাইপুর গ্রামে। দেশভাগের পর চলে আসেন যশোরে।
তাঁর ভাই এ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান ছিলেন ভাষা সৈনিক, যশোর জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ১৯৬৬ সালে তিনি যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে এর আগেই বেসিক ডেমোক্র্যাসির অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি যশোর ইউনিয়ন কমিটির (পৌরসভার) চেয়ারম্যান নির্বাচিত (বিডি চেয়ারম্যান) হন ১৯৬৪ সালে।
সেনাশাসক আউয়ুব খানের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিস-এর ব্যানারে ফাতেমা জিন্নাহ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন। সেই জোটের একটি ছিল আওয়ামী লীগ। ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ১৯৬৪ সালের ১৯শে অক্টোবর যশোরে আসলে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যশোর টাউন হল ময়দানে জনসভার আয়োজন করেন মোশাররফ হোসেনসহ অন্যান্য নেতারা।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’। ছয় দফার পক্ষে যশোর অ লে জনমত গঠনে একনিষ্ঠ থাকেন মোশাররফ হোসেন। ছয় দফার বিরোধিতায় আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এর প্রবল বিরোধিতা শুরু হয় যে তার রেশ দলত্যাগ পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতারা যোগ দিতে থাকেন নবগঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামক জোটে। পিডিএমে ছিল ন্যাশনাল ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্ট, জামাত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও ৮ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ। যশোর আওয়ামী লীগের এ্যাডভোকেট মশিউর রহমান ও এ্যাডভোকেট রওশন আলীর মতো নেতারা পিডিএমে যোগ দিলে শোচনীয় হয়ে পড়ে যশোর আওয়ামী লীগের অবস্থা। তখন দৃঢ় হাতে দলের হাল ধরে থাকেন মোশাররফ। যশোরে ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন অব্যাহত থাকে মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে। ছয়দফার পক্ষে ছাত্রলীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতারা ঐক্যবদ্ধ হন মোশাররফকে কেন্দ্র করে।
আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলে সারা দেশের মতো যশোর অ লেও প্রবল গণআন্দোলনের সূচনা হয়, যশোর অ লে যার নেতৃত্ব দেন মোশাররফ হোসেন। যশোরে সংগ্রামে আপোষহীন থেকে মোশাররফ হোসেন সেই সময় পার করার পর পিডিএম থেকে আবার আওয়ামী লীগে ফেরেন চলে যাওয়া নেতারা। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান যশোরে এলে দলত্যাগী নেতারা ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে।
আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গেলে তাঁর সঙ্গী হন মোশাররফ হোসেন। ১৯৭০ সালে যশোর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয় তাঁকে। একই সাথে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সদস্যপদ পান তিনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন মোশাররফ।
নির্বাচনে জিতে আসাই শেষ কথা ছিল না মোশাররফের জন্য। স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করা ও প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধের সম্ভাবনার কথাও তাঁর মাথায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী সমাজতন্ত্রে অনুরক্ত সদস্যদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ (নিউক্লিয়াস) যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) নামে যুদ্ধ করেছে তাদের সাথে মোশাররফ হোসেনের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
১৯৭০ সালে সাংগঠনিক কাজে যশোরে মোশাররফের বাসায় আসেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব। একই সময়ে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গোপন সাংগঠনিক কর্মসূচীতে যশোরে আসেন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ। মোশাররফ হোসেনের বাসাতেই নিউক্লিয়াসের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মোশাররফের বাসায় আসেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী। যশোরে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মোশাররফের নিরবিচ্ছন্ন সমর্থন তাঁর বাসস্থানটিকে পরে পাকিস্তানী হানাদারদের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে টালাবাহানা শুরু করে। ততদিনে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের প্রত্যাশা সার্বভৌমত্বের দাবি হয়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি তখন প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে অপরিবর্তনীয় এক দফা। সারা দেশের স্বাধীনতাপন্থী নেতা-কর্মীদের মতো যশোরে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন মোশাররফ হোসেন। মোশাররফ হোসেনের বড় কন্যা রওশন জাহান সাথী ছাত্রলীগের ভেতর স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে গঠিত গোপন সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তিনি ১৯৬৮-১৯৭১ সময়কালে যশোর মহাকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং একই সময়কালে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এটি সর্বজনবিদিত যে ছয় দফার মতো স্বাধীনতার প্রশ্নেও আওয়ামী লীগের ভেতর দ্বিমত ছিল। কিন্তু মিছিলের স্লোগানকে যে যুদ্ধের বুলেটে রূপান্তরিত করতে হবে সে বিষয়ে আগেই নিশ্চিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোশাররফ হোসেন। বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা জাহিদ হোসেনের সহায়তায় বিশ্বস্ত ছাত্র-যুবকদের জন্য সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় তাঁর তত্ত্বাবধানে। যশোরের শংকরপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় সে প্রশিক্ষণ চলত। এমন কি তাঁর গুরুদাশ বাবু লেনের বাসার পাশের মাঠেও সন্ধ্যার পর চলত গেরিলা প্রশিক্ষণ।
যশোর আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি দল ছিল। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট মসিয়ুর রহমান, রওশন আলী, সোহরাব হোসেন। অপর দলটির নেতৃত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন। মসিয়ুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত কাছের মানুষ। তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তাঁর ধারণা ছিল দেশকে স্বাধীন করতে হলে প্রয়োজন হবে সশস্ত্র লড়াইয়ের। তাই আগে ভাগে উপলব্ধি করেছিলেন দেশের পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে। এই কারণে নিজের দলের মধ্যে একটি সচেতন বিপ্লবী গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। মসিয়ুর রহমান, রওশন আলী দুজনে ছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে। তখনও পর্যন্ত তাঁরা স্বাধীনতার বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন স্বাধীনতাকে মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগ যশোর জেলা শাখার শীর্ষস্থানীয় একজন রাজনীতিক।
আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাজনীতি করেও তিনি স্বতন্ত্র মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি তার দলের এ অ লের প্রথম নেতা, যিনি মনে করতেন বাঙালিদের জন্য আলাদা একটি আবাসভূমি দরকার- দরকার স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চের মিছিলে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে পাকিস্তানীরা। প্রথমে ছত্রভঙ্গ হলেও মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে মিছিল চলতে থাকে। মিছিলের একটা অংশ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে পৌঁছালে আবার গুলি শুরু হয়। তখন তখন উপায়ন্তর না দেখে আর সামনে যাওয়ার জন্য মোশাররফ সবাইকে অনুরোধ করেন।
মিছিলের অনেকে তখন সমাবেত হন মোশাররফের বাড়ির আঙিনায়। মোশাররফ হোসেনের গুরুদাস বাবু লেনের দোতলা বাসার এক পাশের খোলা ছাদে অবিরাম গুলি করতে থাকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছাদে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানীরা। সেই গোলাগুলির এক পর্যায়ে প্রাণ হারান চারুবালা কর। চারুবালা করের মৃত্যুতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যশোর। হত্যার প্রতিবাদে আবারও মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত হয় যশোর। চারুবালার লাশ নিয়ে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। এদিন মিছিলের নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মসিয়ুর রহমান, মোশাররফ হোসেন, রওশন আলীসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
স্বাধীনতার এক দফা দাবির বাস্তবায়ন ততদিনে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অসহযোগ আন্দোলনে বেকায়দায় পড়া যশোর সেনানিবাসের রসদ সরবরাহের নিশ্চয়তার অনুরোধ ছিল যশোর সেনানিবাসের। পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকালে চা-চক্রের অনুরোধ করে যশোর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে, যাতে করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। যশোর সেনানিবাসে থাকা বাঙালি সদস্যদের কথা মাথায় রেখে সকালের চা-চক্রে যেতে সম্মত হন নেতারা। কিন্তু যেভাবে তাঁরা গেলেন সেখানে তা পাকিস্তানীদের কাছে অভাবিত। তারা দেখে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের বহনকারী গাড়িতে লাগান বাংলাদেশের পতাকা! সে মিটিং থেকে ফেরার সময় দেখা গেল গাড়িতে লাগান বাংলাদেশের পতাকা খুলে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। আরও বড় বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয় পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েলকে নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পতাকা ছাড়া ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানানোয়! মোশাররফ হোসেনসহ উপস্থিত অন্য নেতাদের দৃঢ়তায় পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েল গাড়ি থেকে খুলে নেয়া বাংলাদেশের পতাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
ঘটনা সেখানেই শেষ নয়। কর্নেল তোফায়েল হাজির করে নতুন আবদার। রাতে আলোচনার জন্য ডিনারে যেতে হবে আবার। কিন্তু ততক্ষণে নানান দিক থেকে খবর আসতে শুরু করেছে মোশাররফ হোসেনের কাছে। যশোরের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর কাছে খবর পাঠিয়েছেন যশোরে পাকিস্তানীদের সামরিক প্রস্তুতির বিষয়ে। ঢাকা থেকেও আসে খবর, ‘পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে’।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) -এর সেক্টর কার্যালয় তখন যশোর শহরের ভোলা ট্যাংক রোডে। সেখান থেকে ইপিআরে কর্মরত সেকেন্দার আলী নিয়ে এলেন ভেতরের খবর। সব মিলিয়ে তখন আর আলোচনা নয়, যুদ্ধ প্রস্তুতিই একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠেছে। রাতে ডিনারে যাওয়ার বিষয়ে আলাপ হলে মোশাররফ দৃঢ়ভাবে তার বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য হল যে যদি তাঁরা সেখানে যান, তাহলে পাকিস্তানীরা আর তাঁদের ফিরতে দেবেনা। ওখানেই সব শেষ হয়ে যাবে। তিনি জোর দিয়ে মসিয়ুর রহমানকে বললেন যে, আর যাওয়া যাবেনা। ডিনারে গেলে তারা আমাদের সবাইকে আটক করবে। যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে মতভিন্নতার সমাধান করতে ছাত্রনেতারা স্পষ্টভাবে মোশাররফ হোসেনের পক্ষ নিলেন। যুবনেতাদের ভেতর আলী হোসেন মনি, রবিউল আলম, শেখ আব্দুস সালাম, মশিয়ার রহমান প্রমুখ যুদ্ধপ্রস্তুতির পক্ষে এবং সেনানিবাসে যাওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন।
এরপরও মশিউর রহমানের সাথে মোশাররফের কথা হয় ফোনে। তাঁকে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে পরামর্শ দেন বাসা ছাড়তে। কিন্তু মসিয়ুর রহমান শেষ পর্যন্ত বাসাতেই থাকেন। মসিয়ুর রহমানকে বাসা থেকে আনতে ছাত্রনেতা আব্দুস শহীদকে পাঠান মোশাররফ হোসেন। কিন্তু বাসা ছাড়ে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে দেশ জুড়ে চলা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের আগে মোশাররফ পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দেন অন্যত্র। সেই রাতে যশোরে প্রথম আক্রান্ত স্থাপনাগুলোর একটি মোশাররফ হোসেনের গুরুদাস বাবু লেনের বাসভবন। স্বাধীনতাপন্থী কয়েকজন যুবনেতাকে সাথে নিয়ে বাসভবন ত্যাগের কয়েক মিনিটের ভেতর হানাদার বাহিনীর কয়েক ট্রাক ভর্তি সৈন্য নামে মোশাররফের বাসার সামনে। বাসা থেকে সামান্য দূরে ঘন গাছের পেছন থেকে তাঁরা দেখেন পাকিস্তানি বাহিনীর তা-ব। মোশাররফ হোসেনকে না পেয়ে আক্রোশে বাসার দেয়ালে গুলি চালাতে থাকে পাকিস্তানীরা। মোশাররফ হোসেনের নির্দেশনা অনুযায়ী একদিকে ছাত্র-যুবনেতারা হানাদার বাহিনীর প্রায় প াশ ট্রাকের বহরকে সেনানিবাস থেকে শহরে ঢুকতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে চেষ্টা চলে ইপিআর-এর কাছে থাকা অস্ত্র যথাসম্ভব বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চেই মোশাররফ হোসেন ভারতে পোঁছান। যশোরের বয়রা বর্ডার দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্মকর্তা নেগি তাঁকে তাকে গ্রহণ করেন এবং মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বনগাঁ বারের আইনজীবী কংগ্রেস নেতা অখিল রায় চৌধুরীর বাসাতে পৌঁছে দেন। সেখান থেকে মোশাররফ যান সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে, যিনি পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সহযোগিতাতেই মোশাররফ হোসেন দেখা করেন ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সাথে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতেই তাঁর দেখা হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দিল্লিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভেতর তিনি অন্যতম একজন যিনি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা ও শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিতের চেষ্টা করেন।
২৬ মার্চে যশোরে পাক আর্মি ঘোষণা করা হতে থাকে, মোশাররফ হোসেনকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে আর্থিক পুরস্কার দেয়া হবে। মাইকিং শোনার পর মোশাররফের পরিবারের সদস্যরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার গৃহকর্তা জরুরি কাজের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এতে সন্দেহ হয় মোশাররফের বড় মেয়ে রওশন জাহান সাথীর। তাঁরা দ্রুত সেখান থেকে চলে যান অন্যত্র, থানার কাছে আর এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখান থেকে পরিবারটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়, পরে যাদের আবার দেখা হয় ভারতে।
ভারতে মোশাররফ হোসেন সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করেন যুদ্ধে। ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য স্থাপিত যুবশিবিরের ব্যবস্থাপনা শুরু করেন। সেখানে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সাথেও দেখা হয় মোশাররফের। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী বনগাঁ এলে আবারও তাঁর সাথে দেখা হয় মোশাররফের। ছেলেদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা তো বটেই, সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রসদ, অস্ত্র, গুলি বহনও করেছেন মোশাররফ নিজে। নির্বাচিত এমপিএ হিসেবে রাজনৈতিক তদারকিতেও তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। বন্ধু অখিল রায় চোধুরী মোশাররফ হোসেনের লিয়াজোঁ অফিসের জন্য নিজের বাসার একটা কক্ষ ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সভা আহ্বান করেন শিলিগুড়ির কাছে বেঙডুবি নামের একটি স্থানে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রথমে বাগডোগরা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে মোশাররফ হোসেন পৌঁছান বেঙডুবি
যশোর শহরের গুরুদাশ বাবু লেনের যে বাসায় মোশাররফ হোসেন থাকতেন সে বাসা দখল করে ক্যাম্প বানিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। অজস্র মানুষকে সেখানে জবাই করা হয়েছে। জবাই করার পর ফেলে রাখার পরও কোনমতে পালিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের পর এসে মোশাররফের কাছে বর্ণনা করেছিলেন সেইসব ঘটনা। ছেড়ে যাওয়ার আগে পুরো বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান আর্মি।
সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিজয়ের পরের সময়টা একদিকে যেমন ছিল আনন্দের, তেমন ছিল বিষাদের। হানাদার বাহিনী আর তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের মতো হিং¯্র হায়েনাদের হাতে নিহত লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ ও যুদ্ধে প্রাণদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের শোকে সবাই ছিল মুহ্যমান।
স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে। একদিকে জাতীয় রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রকে কেন্দ্র করে মেরুকরণ। তাই ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসেই মোশাররফ হোসেন পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ থেকে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান কেন তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৬৬ সালের দুঃসময়ে যে মোশাররফ হোসেন যশোর আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, জাতীয়তাবাদ-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাথে গণতন্ত্রের প্রতিও নিষ্ঠাবান সেই মোশাররফ স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়েন।
১৯৭২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর মোশাররফ হোসেনের সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পত্র গৃহীত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দলের যাত্রা শুরুর তোড়জোড় চলতে থাকে। বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন শুরু থেকেই নতুন দলের ভিত্তি তৈরীতে সক্রিয় হন। ১৯৭৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি; আততায়ীরা এসেছিল মোশাররফ হোসেনের চেম্বারে। একজন পিস্তল হাতে আর একজন স্টেনগান হাতে। খুব কাছ থেকে ট্রিগার চাপে তারা। হৃৎপি-ে রক্তস্নান করে চেয়ারের কাঠ ভেদ করে বের হয়ে যায় বুলেট।
আততায়ীর গুলিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাজউদ্দিন আহমদ যশোরে আসেন। শোকবার্তা পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, যোগাযোগমন্ত্রী মনসুর আলী, ড. আলীম আল রাজীসহ অনেকে।
রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে বলি হন মোশাররফ হোসেন, নিজের স্বাধীন দেশে। মোশাররফের রক্ত গিয়ে মেশে যে রক্তগঙ্গায়। মুক্তিযোদ্ধা হত্যার সেদিনের সেই উদ্বোধনই পরে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মাশ্রয়ী শক্তির পুনর্জন্মের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এতো বড় একজন দেশপ্রেমিকের নাম এখন যশোরে উচ্চারিত হয় না, এটা আমাদের দুঃখ।
লেখক- সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।