সারাদেশের মতো কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনেও জমে উঠেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে নৌকা ছেড়ে ট্রাকে উঠেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন। এ নিয়ে তিনি বেশ কয়েক দফা ডিগবাজি দিলেন। নির্বাচনের দিন যখন ঘনিয়ে আসছে ঠিক তখন আবারও ডিগবাজি দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন। মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) রাতে দৌলতপুর থানা বাজারে অনুষ্ঠিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরীর পথসভায় উপস্থিত হয়ে তার ট্রাক প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন এডভোকেট রিমন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এখানকার আওয়ামী লীগ একাট্টা কিংবা গ্রুপহীন ছিল। ওই নির্বাচনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফাজ উদ্দিন আহমেদের পক্ষে কাজ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমনসহ দলটির সবাই। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আলতাফ হোসেনকে হারিয়ে আফাজ উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে এই আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত ছিল। বিএনপির সেই ঘাঁটি আওয়ামী লীগ ভাঙতে সক্ষম হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগের মধ্যেই ভাঙন দেখা দেয়। তৈরি হয় আফাজবিরোধী শক্ত একটি গ্রুপ।
বর্তমান সংসদ সদস্য এডভোকেট আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহর নেতৃত্বে পাল্টা ওই গ্রুপটি গড়ে ওঠে। সরওয়ার জাহান বাদশাহকে আহ্বায়ক করে গঠিত উপজেলা আওয়ামী লীগের পাল্টা গ্রুপের কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন, তখনকার আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী। যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আল মামুন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা প্রায় সবাই আফাজবিরোধী গ্রুপে যুক্ত হন। এখানকার আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর কেন্দ্র ঘোষিত দলের সব কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন হতে থাকে। একপর্যায়ে এডভোকেট আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ এলাকা ছেড়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরে আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী আফাজবিরোধী গ্রুপের মূল নেতৃত্বে আসেন।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফাজ উদ্দিন আহমেদ পুনরায় মহাজোটের প্রার্থী মনোনীত হন। তার সামনে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হয়ে দাঁড়ান আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী। তিনি আনারস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকার প্রার্থী আফাজ উদ্দিনকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন তখনকার এমপি রেজাউল হক চৌধুরীর সঙ্গে থাকলেও উপজেলা নির্বাচনে তার সমর্থন না পাওয়ায় অনেকটা বেঁকে বসেন। আফাজবিরোধী গ্রুপের আরেক যুগ্ন আহ্বায়ক ফিরোজ আল মামুনকে সমর্থন দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জিতিয়ে আনেন রেজাউল চৌধুরী। পরে এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক (বর্তমান সাংগাঠনিক সম্পাদক) ছাদিকুজ্জামান খান সুমনকে সঙ্গে নিয়ে আলাদা আরেকটি গ্রুপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় অনুমোদন না পাওয়ায় রেজাউল চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগের ওই আহ্বায়ক কমিটির অস্তিত্ব হারিয়ে গেলেও শক্ত হাতে আফাজবিরোধী গ্রুপের হাল ধরে রাখেন রেজাউল হক চৌধুরী। রেজাউল চৌধুরীর গ্রুপটি বর্তমানে বাদশাহ্ গ্রুপকেও সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন একেবারেই আলোচনার বাইরে থাকা এডভোকেট আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই নির্বাচনে বাদশাহর পক্ষে দলটির সবাই একসঙ্গে কাজ করেন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পুনরায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদ এবং পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হন এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন। এই কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি হন সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ এবং সহসভাপতি হন আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী। বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আফাজ উদ্দিন আহমেদ করোনায় মারা গেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হন সংসদ সদস্য আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্। আর সিনিয়র সহসভাপতি মনোনীত হন সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী।
উপজেলার পিএম (ফিলিপনগর-মরিচা) কলেজের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত ঘটনায় সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ এমপির সঙ্গে সরাসরি বিরোধে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ নেতা শরিফ উদ্দিন রিমন। এরপর বাদশাহ্কে ছেড়ে রিমন ফিরে যান সাবেক এমপি রেজাউল হক চৌধুরীর গ্রুপে। তিনি বাদশাহর বিপক্ষে এবং রেজাউল চৌধুরীর পক্ষে সরব হয়ে ওঠেন। তবে এডভোকেট রিমনের পরের সেই যাত্রাও স্থায়ী হয়নি। বনিবনা না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় রেজাউল চৌধুরীর গ্রুপে রিমনের অবস্থান বেশিদিন টেকেনি। কিছুদিন পরেই তিনি পুনরায় ডিগবাজি দেন, দ্বিতীয় দফায় ফেরেন বাদশাহর গ্রুপে। এতদিন এমপি বাদশাহর সঙ্গে থাকলেও নির্বাচনের মাত্র চারদিন আগে হঠাৎ করেই রেজাউল চৌধুরীর পক্ষে ভেড়েন এডভোকেট রিমন। সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ ও এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমনের বাড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের ফিলিপনগরে।
মঙ্গলবার রাতে দৌলতপুর থানা বাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থী অালহাজ রেজাউল হক চৌধুরীর পথসভায় উপস্থিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন। তিনি বক্তব্যে রেজাউল চৌধুরীর ট্রাক প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন। এদিকে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনার পাশাপাশি তৃতীয় বারের মতো রেজাউল হক চৌধুরীর পক্ষে রিমনের ফিরে যাওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে। একের পর এক ডিগবাজি দিয়ে তিনি অনেকের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারবার ডিগবাজি দেয়ার কারণে এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন তার নিজের এলাকা ফিলিপনগরেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। এলাকার মানুষজন তাকে খুব একটা পাত্তা দিতে চাইছেন না। কেউ তাকে ডিগবাজিতে সেরা, আবার কেউ সুযোগ সন্ধানী হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। জনসমর্থন না থাকলেও এডভোকেট রিমনকে নিয়ে মুখরোচক কথাবার্তা চাউর রয়েছে।
দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন বলেন, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এখানকার আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার নাম উল্লেখ করে এডভোকেট রিমন বলেন, তারা যদি অমুকের পক্ষে ভোট করতে পারে তাহলে আমি ট্রাকের পক্ষে ভোট করলে দোষ কোথায়। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে রেজাউল হক চৌধুরী দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রিমন।
এদিকে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সংসদ সদস্য আ. কা. ম সরওয়ারর জাহান বাদশাহ্ (নৌকা), সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী (ট্রাক) ও তার ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগ সভাপতি বুলবুল আহমেদ টোকেন চৌধুরীকে শোকজ করা হয়। ইতোমধ্যে তারা নিজেদের মতো করে এসব শোকজের জবাব দিয়েছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা শেষ দিকের গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলাজুড়ে চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে শঙ্কাও বিরাজ করছে।
বিএনপিবিহীন এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দৌলতপুর আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বর্তমান সংসদ সদস্য এডভোকেট আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের মাঠে সরব রয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত অাফাজ উদ্দিন আহমেদের জ্যেষ্ঠপুত্র অধ্যাপক নাজমুল হুদা পটল স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ঈগল প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগাঠনিক সম্পাদক। এছাড়া দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ আল মামুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কেটলি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।
আওয়ামী লীগের চারজন প্রার্থী ছাড়াও অন্যান্য দল মিলে মোট ১০ জন প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। অপর দলগুলোর প্রার্থীরা হলেন- জাতীয় পার্টির শাহরিয়ার জামিল জুয়েল (লাঙ্গল), জাসদের শরিফুল কবির স্বপন (মশাল), ওয়ার্কার্স পাটির মজিবুর রহমান (হাতুড়ি), তৃণমুল বিএনপির আনিছুর রহমান (সোনালী আশ), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সাজেদুল ইসলাম (ছড়ি) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের সেলিম রেজা (ডাব)। ৩ লাখ ৮০ হাজার ২৮৭ ভোটারের এই সংসদীয় আসনটিতে নৌকা, ট্রাক ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সব রকম সম্ভাবনা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের হিসাব নিকাশ প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। সামনে আসছে নতুন সমীকরণ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।