সাতক্ষীরা সদর আসনে
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় হাইকমান্ড এবার বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজ ও এলাকায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন।
সাতক্ষীরার চারটি আসনের ৩ টিতেই আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে পুরাতনদের বাদ দিয়ে নতুন মুখ আনা হয়। সদরে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে রাতারাতি পাহাড় পরিমান জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে উঠে যান তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাতক্ষীরা সদরের পরপর দুইবারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু। চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যান। সকলের সাথে ভালো ব্যবহার এবং এলাকার মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় দলমত নির্বিশেষে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। বি.এন.পি-জামায়াতের বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বাবু দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সাথে সাথে হাফ ছেড়ে বাঁচেন বিভিন্ন কারণে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। কিন্তু চূড়ান্তভাবে সাতক্ষীরা সদর আসন শেষ পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির হাতে।
রংপুরের পরেই একসময় দলটির শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল এই সাতক্ষীরা। ৯০-এর গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্নস্থানে জাতীয় পার্টি কোণঠাসা হয়ে পড়লেও সাতক্ষীরায় তার প্রভাব পড়ে কম। ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে জাতীয় পার্টি বড় দলগুলোর মতোই ভালো ফল করে জেলার আসনগুলোতে। এসব বিষয় বিবেচনা রেখেই জোট-মহাজোটের আসন সমঝোতার জাতীয় পার্টি জেলার দুটি আসন পাওয়ার জন্য জোর তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও শেষ মুহূর্তে তাদেরকে দেওয়া হয় সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন। প্রার্থী হন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু।
তিনি সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এসাসিয়েশনের সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার দীর্ঘদিনের সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে সাতক্ষীরায় ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেন। শহরের কাটিয়া এলাকায় পৈত্রিক বিপুল পরিমান ভূ-সম্পত্তির মালিক এবং অর্থনৈতিক সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের শীর্ষ পদে থেকেও বছর বছর পৈত্রিক জমি বিক্রি করে তিনি রাজনীতি ও সমাজসেবা করে আসছেন। ফলে বি.এন.পি-জামায়াতের বর্জন এবং জোট-মহাজোটের আসন সমঝোতার সমীকরণে প্রার্থী হওয়া আশরাফুজ্জামান আশুর সামনে কোন চ্যালেঞ্জ থাকার সম্ভাবনা কম। তারপরও প্রচার প্রচারণায় তাকে টেনে হিচড়ে নিচে নামানোর প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত বর্তমান সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। এছাড়াও প্রার্থী হয়েছেন বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী আফসার আলী, তৃণমূল বিএনপির মোস্তফা ফারহান মেহেদী, বিএনএম এর কামরুজ্জামান বুলু, এনপিপির আনোয়ার হোসেন এবং স্বতন্ত্র ইনসান বাহার বুলবুল।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ রিটানিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের গণনা শেষের ঘোষণায় বিজয়ী হন। যা রেডিও, টিভিসহ সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। কিন্তু সকালে ফলাফল উল্টে যায়। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী জামায়াতের কাজী সামসুর রহমান ৫৪ হাজার ৯৬ ভোট বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ ৫৩ হাজার ৭৮৭ ভোট, আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম ৪৫ হাজার ৪৫০ ভোট এবং বিএনপির এম মুনসুর আলী ১৪ হাজার ৬৮২ ভোট প্রাপ্ত হন।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির মহাজোট নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির এম.এ জব্বার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪২২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বি.এন.পি-জামায়াত জোটের আব্দুল খালেক মন্ডল পান ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৫৭ ভোট।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের ২০১৪ সালের নির্বাচনে সদর আসনে পুনরায় মহাজোটের প্রার্থী হন জাতীয় পার্টির এমএ জব্বার। কিন্তু হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যান। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পার্টিও ছিল দোদ্যুল্যমান। কথিত আছে কৌশলে জাতীয় পার্টির একটি পক্ষের সম্মতি নিয়ে বিদেশে থাকা এম.এ জব্বারের স্বাক্ষর জাল করে তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো হয়। ফলে মহাজোটের প্রার্থী না থাকায় নৌকার প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুযোগ পান। তিনি ৩২ হাজার ৮৫৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল করিম সাবু পান ১৫ হাজার ৭৮৯ ভোট। পরবর্তী ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মীর মোস্তাক আহমেদ রবি নৌকার মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। কিন্তু দুইবারের এই এম.পি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি নানা কারণে আলোচনা সমালোচনার মুখে এবার দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন। নৌকা পান তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবু। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দলীয় সিদ্ধান্তে নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবু জাতীয় পার্টির প্রার্থী আশরাফুজ্জামান আশুর পক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন।
এদিকে সদর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নেমেছেন বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী আফসার আলী। কর্মসূত্রে ঢাকায় বসবাস করেও এলাকায় তার ছিল নিবিড় যোগাযোগ। বিশিষ্ঠ সমাজসেবক আফসার আলী ফ্যালকন হোমস লিমিটিড, লিংক টেক আইটি লিমিটেড, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী সমবায় সমিতি লিমিটেড, গভ. এমপ্লয়িজ ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন হাউজিং সোসাইটি লি. এর চেয়ারম্যান এবং এ.এস.এম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের মরহুম আব্দুল বারী মল্লিকের মেজ ছেলে আফসার আলী কর্মস্থল ঢাকায় অবস্থান করেন। তিনি শ্রীরামপুর ইউনাইটেড মডেল কলেজ, ভোমরা ইউনিয়ন পল্লী শ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া মরহুম আব্দুল বারী মল্লিক হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, বৈচনা রোকেয়া খাতুন চ্যারিটি ডায়াবেটিক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি। এছাড়াও ভোমরা ইউনিয়ন দাখিল মাদ্রাসার ফাউন্ডার ও সদস্য, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা লাইভস্টক এসোসিয়েশন, ঢাকার প্রধান উপদেষ্ঠা এবং ডিপ্লোমা ইন স্টুডেন্ট ফেড়ারেশন অব বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, চৌবাড়িয়া জান্নতুল ফেরদৌস জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বপ্নের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, ঢাকার প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়াও অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এলাকার মানুষের অনেকের কাছে তিনি দানবীর হিসেবেও পরিচিত। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর তার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ফলে নির্বাচনে ফলাফলের ব্যবধান যাই হোক না কেন তিনিই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন-এমনটাও মনে করেন অনেকে।
আবার আসাদুজ্জামান বাবু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পরও প্রার্থী তালিকায় থেকে গেছেন তার নিকট আত্মীয় আওয়ামী লীগ নেতা এনছান বাহার বুলবুল। শহরের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ও সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক বুলবুলের কোন প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়েনি গত দু’দিনে। কিন্তু প্রার্থী তালিকায় তার নাম থেকে গেছে। ফলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাহারের পর আসাদুজ্জামান বাবু সমর্থকরা তার আত্মীয়ের দিকে হেলে পড়বেন কি না এমন আশঙ্কার কথাও কেউ কেউ মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও তৃণমূল বিএনপির মোস্তফা ফারহান মেহেদী, বিএনএম-এর কামরুজ্জামান বুলু এবং এনপিপির আনোয়ার হোসেন ভোটের মাঠে প্রার্থী হিসেবে কোন চমক দেখাবেন কি না সেই অপেক্ষায় রয়েছে সাতক্ষীরা সদরের ভোটাররা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।