বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

আগের সংবাদ

যশোর শিক্ষাবোর্ডসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজয় দিবসের আলোচনা সভা

পরের সংবাদ

লুণ্ঠিত গৌরব বহুলাংশে পুনরুদ্ধার তবুও চ্যালেঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১:২৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ৩:১৩ অপরাহ্ণ

‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এভাবেই স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ।

মহান একাত্তরে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অস্ত্র হাতে ৯ মাস যুদ্ধ করেছিল বীর বাঙালি। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এসেছে কাক্সিক্ষত বিজয়। তবে বিজয়ের ৫২ বছরে এসেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কতটুকু এগুলো বাংলাদেশ- এমন প্রশ্ন সর্বত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন এখনো অধরা। স্বাধীনতার সাড়ে ৩ বছরের মাথায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে উল্টোপথে যাত্রা করে বাংলাদেশ। বন্দুকের নলের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত সংবিধান থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তনে দেখা দেয় নানা বৈপরীত্য। ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দুর্নীতির ক্রমবিকাশে মুখথুবড়ে পড়ে বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল ৩টি- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল। বাঙালিরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে দেখে পাকিস্তানি হানাদাররা ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি নিধনে। অন্যদিকে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা ছিল না। শাসন ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক; অসামরিক ও সামরিক। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি।

বাংলাদেশ গঠনের পর বাহাত্তরের ২২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই ৪ মূলনীতি দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই ৪টি মৌলিক নীতির ধারায় বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। এটিকে মুজিববাদ বা অন্য যে কোনো নামে অভিহিত করা হোক না কেন, আমার কিছু বলার নেই। আমি এই চারনীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষতবিক্ষত সংবিধান ও সামরিক শাসিত রাষ্ট্র চারনীতির পরিবর্তে ফিরে যায় পাকিস্তানি ভাবধারায়।

বিজয়ের অর্ধশতকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কতটুকু এগুলো বাংলাদেশ- এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান থেকে সমাজ-রাষ্ট্র অনেক দূরে। সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয়ে গেছে চার মূলনীতি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র চেয়েছিলেন কিন্তু গত ৫২ বছরে এই বৈষম্য আরো বেড়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ এখন প্রায় বিস্মৃত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী- এ বিষয়টি কারো বোধগম্য কিনা, এ নিয়ে আমার সংশয় আছে। ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ধর্মভিত্তিক কোনো রাষ্ট্র হতে পারে না। বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, আরেকটি সমাজতন্ত্র- এই দুই নীতিকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতিটি পালিয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাড়ছে। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্য এত দূর গড়িয়েছে, তাদের কথায় পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হয়। শেখ হাসিনা এখন কওমি জননী। তাদের সরকারিভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খুঁজে পাই না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু মুখে আছে কিন্তু বুকে নেই।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসকে উপহাসে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। এর দায় যেমন রাজনীতিবিদদের, তেমনই পেশাজীবীদেরও রয়েছে। অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার পর থেকেই নানা রকম অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে। জানতে চাইলে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা আজো পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক হিসেবেই পরিচিত থাকতাম। তবে স্বাধীন দেশে ইতিহাসের স্বাভাবিক যাত্রাপথ নষ্ট করা হয়েছে পঁচাত্তরে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন অপশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কাক্সিক্ষত অর্জন-সফলতার বড় অংশই বিনষ্ট হয়েছে অন্ধকার সময়ে। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। লুণ্ঠিত গৌরব বহুলাংশে পুনরুদ্ধার হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যদিকে যখন স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি তখন রাষ্ট্রের স্থপতির ভাস্কর্যে আঘাত হানে মৌলবাদী গোষ্ঠী। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় ফুলে-ফেঁপে আরো বড় হয়েছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে আঘাত হেনেছে যার অর্থ তারা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং রাষ্ট্রের ওপর আঘাত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মৌলবাদের বিস্তার, ধর্মের অপব্যাখ্যা, ইতিহাস বিকৃতির কারণে আদর্শহীনতার রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, মৌলবাদীরা শুধু সংস্কৃতির ওপরই আঘাত করছে না, তারা পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন চায়, আইনের পরিবর্তন চায়। তবে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিকামী। মুক্তির চেতনা বাস্তবায়নে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, এখনো যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত জাতি।

তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এখনো অনেক দূর- এমনটাই মনে করছেন সুধিমহল। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অন্তরায় রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি জোটের একচ্ছত্র অবস্থান। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য কঠিন হয়ে গেছে। সংসদ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনসহ প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। প্রতি মুহূর্তে খর্ব হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ডিজিটাল আইনে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এসবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়।

বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর এর মধ্য দিয়েই সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। নতুবা ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মতো রাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানবে ধর্মান্ধরা। এখুনি এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সবার রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়