কারিগরদের জীবন কাটছে দৈন্যতায়
আবহমান বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির বাহক মৃৎশিল্প। মা মাটির ভালোবাসা মাখানো নিপুণ হাতের কারুকার্যের মাধ্যমে তৈরি তৈজসপত্রের এ শিল্পটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে কালের গহ্বরে। মুমূর্ষু প্রায় হয়ে যেটুকু আছে তা যেন সাহিত্যের রচনার পাতায়। এক সময় বাসা-বাড়িতে হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারে কদর ছিল মাটির তৈজসপত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের ভালোবাসার সেই জীবিকার জায়গাটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, সভ্যতার আধুনিকতায় ততই বাড়ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার। আর প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে মাটির তৈরী তৈজসপত্রের জায়গা দখল করছে প্লাস্টিক ও এ্যালমুনিয়ামের তৈরি সামগ্রী। ফলে এক সময় জৌলুস আর দাপট থাকা এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ভালো নেই এই পেশায় থাকা কারিগর ও বিক্রেতারা। মহামূল্যবান এ মৃৎশিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের কে কুমার বা পাল বলা হয়।
হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রেখে কোনরকম জীবিকা নির্বাহ করছেন মাগুরার শালিখা উপজেলার দরিশলই, ছান্দড়া, বয়রা, গোবরা, শতপাড়া, গঙ্গারাপুর, পাশ্চাত্য রাঘবদাইড়, কেচুয়াডুবীসহ অনেক গ্রামের পালপাড়ার বেশ কিছু পাল পরিবার কোন রকমেএখনো আকড়ে আছে এ শিল্পে। সেটা অনেকটা খরস্রোতা নদীতে বাঁধের বাঁশের মত কম্পনরত দন্ড জড়িয়ে ধরিয়ে, আর শেষ বিকেলের নিবু নিবু প্রদীপ সূর্য শিখা হয়ে। এই পেশা থেকে কোনো রকম আয় করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছেন এখানকার মৃৎশিল্পরা। মাগুরার শালিখা উপজেলা সদর আড়পাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে গেলেই দরিশলই পালপাড়া। শতাধিক পাল পরিবার বসবাস এখানে। এখানে পালেরা তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করে তৈজসপত্র, রয়েছে মাটির তৈরি হাড়ি, সরা, কলস, ফুলের টব, দেবদেবীর মূর্তিসহ আরো অনেক কিছু। এক সময় মাগুরা জেলার বাইরেও এখানকার মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। পরিবর্তে স্থান দখল করেছে স্টেইনলেস স্টিল, প্লাস্টিক, অ্যালমুনিয়ামের তৈরি সরঞ্জাম। তাই স্বচ্ছলতা না থাকায় জীবন-জীবিকার তাগিদে এ শিল্পের আশা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকে।
সরজমিনে দরিশলই গ্রামের পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাটি সংগ্রহ করে শক্ত একটি কাঠের উপর বৃত্তাকার চাকা বসিয়ে সুনিপুণ কৌশলে তৈরি করছেন থালা বাসন, মাটির পুতুল, কলসসহ বিভিন্ন জিনিস। মৃৎশিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল, নির্মল পাল, হারাধন পালসহ অনেকে জানান, আগে মাটি বিনামূল্যে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন মাটি কিনে নিতে হয়। তাছাড়া এসব জিনিসপত্র পোড়ানোর জ্বালানি কাঠের দাম বেশি। তাই লাভ হয় খুব সীমিত। কাঁচা হাড়ি পাতিল তৈরি করে রোদের শুকিয় পাঁজা পোড়াতে ১০/১২দিন সময় লাগে খরচ হয় প্রায় ১৩হাজার টাকা এবং বিক্রি করি ১৫ থাকে ১৮ হাজার টাকা।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সরা, বাসুন গড়ার কাজে সর্বক্ষণ সাহায্যে করে থাকে। আয়ের জন্য অন্য কোনো উৎস না পেয়ে জীবিকার তাগিদে অনেকে পুরাতন এ পেশায় ধরে রেখেছে বলে জানান তারা। কিন্তু কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় এবং আয় কমে যাওয়াই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। তাই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা প্রত্যাশা এখানকার মৃৎশিল্পীদের।
তবে নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্রের ব্যবহার কমলেও বেড়েছে পোড়ামাটির গৃহসজ্জার চাহিদা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারো হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে এমনটাই মনে করেন এখানের মৃতশিল্পীরা।
এ প্রসঙ্গে কাটাখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব শাহজাহান মৃধা বলেন, “মৃৎশিল্পের বিভিন্ন ব্যবহার বাড়িতে যেমন শোভনীয় বিভিন্ন অফিস আদালতে এগুলো সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য আকর্ষণীয়।তাই এই শিল্পের সাথে জড়িত সকল মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করে এবং ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারের নিকট বিভিন্ন প্রণোদনা সহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।