স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে এলাকাবাসী
বেনাপোল স্থলবন্দরে বছরের পর বছর যেখানে সেখানে কেমিক্যাল বর্জ্য ফেলে রাখায় মারাত্মকভাবে পরিবেশে দূষণ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষকে এসব বর্জ্য সরানোর জন্য অনুরোধ করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই। এতে মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এলাকাবাসী।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্দরে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পড়ে থাকা কেমিক্যাল বর্জ্য সৃষ্টি হয়েছে। আইনি জটিলতায় তারা এগুলো সরাতে পারছে না। তবে দ্রুত যেন এসব বর্জ্য নিষ্কাশন হয় এজন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানা যায়, দেশে শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত যে কাঁচামাল কেমিক্যাল ভারত থেকে আমদানি হয়ে থাকে তার ৭০ শতাংশ বেনাপোল বন্দর দিয়ে হয়। এসব পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যাসিড, রাসায়নিক দ্রব্য ও কেমিক্যাল জাতীয় পাউডার ও বিস্ফোরক দ্রব্য রয়েছে। কিছু কিছু রাসায়নিক পণ্য এতো বিপদজনক যে ট্রাকে বা গোডাউনে থাকা অবস্থায় তেজস্ক্রিয় হয়ে আগুন ধরে যায়।
গত ১২ বছরে বেনাপোল বন্দরে এ ধরনের ছোট বড় ৭টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডের পর ওই সব কেমিক্যালের বর্জ্য নিরাপদ কোনো জায়গায় না সরিয়ে বছরের পর বছর বন্দর অভ্যন্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এতে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। সৃষ্টি হয়েছে জায়গা সংকট। বন্দরে যারা ২৪ ঘণ্টা পণ্য খালাসের কাজ করছে সেই শ্রমিকরাও নিরাপদে নেই।
ভুক্তভোগী বন্দর এলাকার গ্রামবাসী বদরউদ্দিন বলেন, বন্দরের বর্জ্যের কারণে বিভিন্নভাবে তারা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া বন্দরের মধ্যে থেকে অ্যাসিড মিশ্রিত পানি প্রবেশ করছে জনবসতি এলাকায়। এতে তাদের চলাচল ও বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গত ১০ বছর ধরে ভুক্তভোগী মানুষ বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এর থেকে পরিত্রাণের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা হচ্ছেনা। এতে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে।
বেনাপোল বন্দরের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, বন্দরের ধারণ ক্ষমতা ৫০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সেখানে সব সময় পণ্য থাকে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন। এতে জায়গা না পেয়ে মূল্যবান সামগ্রী খোলা আকাশের নিচে রাখতে হয়। ফলে পণ্যের গুণগতমান নষ্ট হয়। কেমিক্যাল বর্জ্য সরিয়ে নিলে পন্য খালাসের সুবিধা বাড়বে।
বেনাপোল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (রসায়ন) প্রদীপ কুমার সরকার বলেন, কেমিক্যাল বর্জ্য বাতাসে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে চুলকানিসহ স্কিন ক্যানসার হতে পারে।
পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিন ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আশিক মাহামুদ সবুজ জানান, যত্রতত্র কেমিক্যাল বর্জ্যে নানাভাবে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি পরিবেশের উপরও আঘাত হানতে পারে। তাই এসব বর্জ্য সংরক্ষণে রাখা উচিত।
বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম বলেন, আমদানিকৃত ভারতীয় কেমিক্যাল পণ্যে আগুন ধরে এ বর্জ্যের সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত যাতে এসব বর্জ্য নিষ্কাশন করা যায় এজন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কাস্টমসকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।
বন্দর সূত্র মতে, ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল বন্দরে ৩১ নাম্বার ইয়ার্ডে আগুনে ৫টি ভারতীয় ট্রাক ও মেশিনারিজ পণ্য পুড়ে যায়, ২০২১ সালের ৭ জুন সন্ধ্যা ৭টায় বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যাগারের সামনে মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকে অগ্নিকান্ডে মালামালসহ একটি ট্রাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে বন্দরের ১০ নম্বরসহ ১০টি পণ্যাগারে আগুনে পুড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়; ২০০১ সালে ২৬ নম্বর পণ্যাগারে অগ্নিকান্ডে ক্ষতি হয় ৩০ কোটি টাকার; ২০০৫ সালে ১০ ও ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনের ঘটনায় ক্ষতি হয় ৭০ কোটি টাকা; ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারিতে ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা, একই বছরের ২২ জুন ২৭ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় ১৫০ কোটি; ২০১৬ সালে ২ অক্টোবরে ২৩ নম্বর পণ্যাগারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা; ২০১৮ সালের ৬ জুন বন্দরের ২৫ নম্বর শেডে আগুন ধরে এক ট্রাক পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভারতীয় ট্রাক টার্মিনালে এ ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে অগ্নিকা- প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায় এবং সর্বশেষ গত ৭ জুন বেনাপোল বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যাগারের সামনে মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ব্লিচিং পাউডারবাহী ট্রাকে আগুন লেগে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া ছোটখাটো আরো পাঁচ, ছয়টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।