খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) তো নয়, চলছে যেন হরিলুট! এতে যে পরিমাণ চাল-আটা দিয়ে কমপক্ষে ১২ কোটি ৪১ লাখ মানুষে চাহিদা মেটানো সম্ভব, তা মাত্র ৮১ লাখ ৬৮ হাজার জনের কাছে বিক্রি করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ভর্তুকি দিয়ে চালানো এমন বেহিসেবি কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। অন্যদিকে, কোথাও কোন অপচয় বা দুর্নীতি হচ্ছে না বলে দাবি ডিলার ও খাদ্য অধিদফতরের প্রতিনিধিদের।
একজন মানুষ প্রতিদিন ৫ কেজি চাল, ৫ কেজি আটা খায়! অসম্ভব মনে হতে পারে। না, এমন মানুষ খুঁজতে কাল্পনিক জগতের কোন রাক্ষসপুরিতে যেতে হবে না। এ রকম লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশেই আছে, যাদের বাজার মূল্যের অর্ধেকে পণ্য দুটি দিচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
চলুন, ওএমএসের ব্যানারে লেখা ভোক্তা আচরণ দিয়েই শুরু হোক। যেখানে প্রতিদিন একজনের কাছে ৫ কেজি করে চাল ও আটা বিক্রি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আসলেই কি একজন একদিনে ১০ কেজি চাল-আটা খান?
অপচয়-দুর্নীতির ইঙ্গিত বিশ্লেষণের আগে জানা দরকার – একজন স্বাভাবিক মানুষের দিনে আসলে কতো গ্রাম চাল লাগে? সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে – ৩২৯ গ্রাম। তাহলে কী দাঁড়াল – দৈনিক ১৫ জনের বেশি মানুষের চাল একজনকেই খাওয়াচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়!
তাহলে এই চাল-আটা যাচ্ছে কোথায়, আর খাচ্ছেনই বা কে? ক্রেতারা বলছেন, চাল-আটার বস্তা থাকার পরও তারা দিতে অস্বীকার করছেন। অভিযোগ, এগুলো বাইরে নিয়ে বিক্রি করবে, এজন্য এমন অবাস্তব হিসাব।
চলুন দেখি এবার এ হিসাবকে মাইক্রোস্কোপে ফেললে কী দেখা যায়? খাদ্য অধিদফতরের তথ্য, ওএমএসের মাধ্যমে প্রতিদিন বিক্রি হয় ২ হাজার ৪২ মেট্রিক টন চাল ও আটা। বিবিএসের হিসাব মেনে এ দুটি পণ্যের চাহিদা সমপরিমাণ ধরলে এ খাদ্য দিয়ে দৈনিক ৬২ লাখ ৬ হাজার ৬৮৭ জনের চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথচ দৈনিক জনপ্রতি ৫ কেজির হিসাবে তা পাচ্ছেন ৪ লাখ ৮ হাজার ৪০০ জন। অর্থাৎ ১৭ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে মাসে ২০ দিন চালানো এই কার্যক্রমে ১২ কোটি ৪১ লাখ মানুষের চাহিদা মেটানো চাল-আটা বিক্রি করা হচ্ছে মাত্র ৮১ লাখ ৬৮ হাজার জনের কাছে।
এতো গেল স্বচ্ছভাবে বিক্রি কার্যক্রমের হিসাব। রাজধানীতে এক ট্রাক থেকে আরেক ট্রাকের যে দূরত্ব তাতে একবেলার মধ্যে ৫ জনের একটি চক্র তিনটি স্পট থেকে প্রতিদিন ভর্তুকিমূল্যে এ চাল-আটা কিনতে পারবে ১৫০ কেজি। নিজের চাহিদা মেটানোর পরও যা কেনাবেচা করে দৈনিক আয় করতে পারবে কমপক্ষে ২ হাজার ২২০ টাকা। জানা দরকার, বর্তমান কার্যক্রমে এমন দুষ্ট চক্র ঠেকানোর উপায় কতোটা শক্তিশালী!
উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে এমন ঠুনকো নজরদারিতে এভাবে চাল-আটা বিক্রিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আনার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিরডাপের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, এমন ক্ষেত্রে যদি ক্ষতি হয়, তাহলে সরকারকে এগুলো বন্ধ করতে হবে। না হলে যে উদ্দেশ্য থেকে এ কার্যক্রম হাতে নেয়া, তা সুফল বয়ে আনবে না।
বিবিএসের তথ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ রয়েছে সোয়া তিন কোটিরও কম। ওএমএসকে আরও সুচারুভাবে সাজাতে পারলে বর্তমান ব্যয় দিয়েই তাদের ন্যূনতম চাহিদার তিনগুণ বেশি চাল-আটা পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
ওএমএসের চাল-আটায় হরিলুট। একজন দৈনিক পাচ্ছেন ১৫ জনের খাদ্য। চলছে বিক্রি-বাট্টা। অপচয়-দুর্নীতি নেই, দাবি সংশ্লিষ্টদের। সরকারের নিয়ন্ত্রণ আনার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।