সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমল থেকে আন্দোলন করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রজীবনে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ভোট-ভাতের লড়াইয়ের অধিকারে সোচ্চার ছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সময়ে তাকে আন্দোলন করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিতি করতে হয়েছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ভোটার বাক্স, আইন পাস, ভোটের অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে- সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে হঠাৎ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে ‘মাতামাতি’ সন্দেহজনক বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, আমাকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন শেখাতে হবে না। এজন্য আমাদের অনেক মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। এখন এত প্রশ্ন আসে কেন? দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে তখন এত প্রশ্ন আসছে কেন? তখন বলতে হয়, সন্দেহ হয় রে, সন্দেহ হয়। গতকাল শুক্রবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে এই কথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান ও যুক্তরাজ্য সফর সম্পর্কে জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত জানতে চান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। সরকারও একই কথা বলছে। তাহলে আমেরিকা আর সরকারের আকাক্সক্ষার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তারা বাস্তব অবস্থাটা বোঝে কিনা আমি জানি না, একই রেকর্ড তারা বাজিয়ে যাচ্ছে। সেটা আমি স্পষ্ট বলে এসেছি। ভোটের জন্য আমরা সংগ্রাম করলাম। রক্ত দিয়ে, আমার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার অর্জন করে দিয়েছি। এমন নয় যে নতুন এসেছি। স্কুল জীবন থেকেই রাস্তায় আন্দোলন সংগ্রাম করছি। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে করেছি, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে করেছি। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া সবই তো ভোট চোর। আওয়ামী লীগ আসার পর আওয়ামী লীগের তো ভোট চুরি করা লাগে না। আওয়ামী লীগকে তো জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়। কাজের মধ্যে দিয়ে আস্থা অর্জন করি আমরা। তিনি বলেন, একটা দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে থামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা কি না সেটা প্রশ্ন আমারও। আসল কথা নির্বাচনটা বানচাল করে দেয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা গণতন্ত্রকে আওয়ামী লীগই জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কিছু লোক নির্বাচন নিয়ে ‘একটু বেশি কথা’ বলে, সে কারণে বিদেশিরাও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়। আর দুর্ভাগ্য হল যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে, জনগণের ভোট চুরি করে ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করেছে, সেই সময় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগ দেখিনি। মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তায় দেশের ১৫৮ জন নিরাপত্তা কর্মী আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তায়ও গানম্যান দেয়া হয়েছে, আর কী চাই?
যারা ভোট চুরি করেছে তাদের কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনতে হয় মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া সবই তো ভোট চোর। এদেশের মানুষ জানে, নৌকায় ভোট দিয়ে উন্নতি হয়েছে। মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। দারিদ্র্যসীমা ৫ শতাংশে কমিয়ে এনেছি। কেউ ঘরবাড়ি ছাড়া থাকবে না। সন্দেহ হয় সেজন্যই।
মিথ্যা কথায় কান দেবেন না : বিএনপির মিথ্যা কথায় কান না দিতে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি বলেছে আমি খালি হাতে আছি এই তো? আমি কোনো উত্তর দিতে চাই না। শুধু দেশবাসীকে বলতে চাই, বিএনপি নেতারা মাইক লাগিয়ে কী হারে মিথ্যা কথা বলে, সেটি আপনারা জেনে নেন। মিথ্যা বলা তাদের অভ্যাস। এ বিষয়ে দেশবাসী যেন একটু সচেতন থাকে। তাদের মিথ্যা কথায় কেউ কান দেবেন না। মিথ্যা কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না। ওদের জন্ম হয়েছে অবৈধভাবে, টিকেও আছে মিথ্যার ওপরে। আর কোনো শিকড় তো নেই। তবে আন্দোলনের নামে বিএনপি সাধারণ মানুষের কেনো ক্ষতি করলে ছাড় দেয়া হবে না।
তারা আর মানুষ পোড়াতে পারবে না। মানুষ পুড়িয়ে আর বাঁচতে পারবে না।
বিএনপির আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা বারবার তারিখ দিয়েই যাচ্ছে। এই তারিখে ফেলে দেবে, ওই তারিখে ফেলে দেবে। তারা আন্দোলন করুক। জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতি যদি করা হয়, সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। আমরা তাদের আন্দোলনে বাধা দিচ্ছি না। তারা আন্দোলনে লোকসমাগম করছে। খুব ভালো কথা। এতকাল চুরি করে যা টাকা বানিয়ে ছিল আর যে টাকা মানিলন্ডারিং করে ছিল, সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে। অন্তত মানুষের পকেটে কিছু টাকা তো যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন, বিএনপি এত টাকা কোথা থেকে পায়, সেই খবর যাতে নেয়া হয়। এই যে তাদের সোর্স অব মানি- এটা কোথা থেকে? সেটা একটু খবর নেয়া দরকার, তারা এত টাকা কোথা থেকে পায়। এত টাকা কীভাবে খরচ করে, একটু খোঁজ নেয়া দরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি তো মাইক একটা লাগিয়েই রাখে। বলে আমাদের কথা বলতে দেয় না। আমরা নাকি তাদের মিছিল মিটিং করতে দিই না। আমরা তো ওদের খুলে দিয়েছি, যা খুশি করো। নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে আস। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই প্রতিযোগিতা থাকতে হবে, বিরোধী দল থাকতে হবে। কিন্তু বিরোধী দল কে? পার্লামেন্টে একটা সিট নেই। বিরোধী দল হিসাব করে তো রাখা যায় না। যার নির্বাচন করার মতো সাহস নেই। নির্বাচন করে পার্লামেন্টে আসতে পারে না। তারা আবার বিরোধী দল কিসের? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদে যাদের আসন আছে, তারাই বিরোধী দল। রাস্তায় কে ঘেউ ঘেউ করে বেড়াল, সেটাকে বিদেশে কখনো বিরোধী দল হিসেবে ধরে না। এটা সবার মনে রাখা উচিত।
আাগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই হবে যোগ্যতা, মানুষের আস্থা আর এলাকায় কর্মকাণ্ডের আমলনামায়- এই মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, বিএনপির আন্দোলনে দল চাঙ্গা হচ্ছে, আর মনোনয়ন পেতে এলাকায় মন দিচ্ছেন নেতারা। এটা ভালো। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেনি বলেও জানান তিনি।
রিজার্ভ আ.লীগই বাড়িয়েছে : রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষ যদি বলে রিজার্ভ রক্ষা করতে হবে, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেই, পানি দেয়া বন্ধ করে দেই, সার দেয়া বন্ধ করে দেই। সব বন্ধ করে বসিয়ে রাখি, আমাদের রিজার্ভ ভালো থাকবে। তিনি বলেন, করোনার সময় আমদানি বন্ধ ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। তখন তো রিজার্ভ বেড়েছিল। এরপর যখন সব খুলে গেল, সবকিছু আমদানি শুরু হলো। তখন রিজার্ভ কমবে, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা যখন ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন রিজার্ভ ১ বিলিয়নও ছিল না। ছিল শূন্য দশমিক সাত। আমি যখন ৯৬ সালে সরকার গঠন করি তখন রিজার্ভ ছিল বিলিয়নের নিচে। যেটুকু বেড়েছে, আমাদের সরকারই বাড়িয়েছে।
প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রিজার্ভ বেশি রাখা বেশি প্রয়োজন- নাকি দেশের মানুষের ভালো, মানুষের জন্য কাজ করা বেশি প্রয়োজন। ২০০ ডলারে গম কিনতাম, তা এখন ৬০০ ডলার। ৮০০ ডলারের পরিবহন খরচ এখন ৩-৪ হাজার ডলার লাগছে। রিজার্ভ নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। আমি তো বলেছি যে যদি এত বেশি কথা হয়, যখন সরকার গঠন করেছিলাম, রিজার্ভ ওইখানে রেখে তারপর ইলেকশন করব। পরে আবার বাড়াব। কিন্তু, করে দেখাব যে এই ছিল। বিদ্যুৎ শতভাগ থেকে কমায়ে ওই ২৮ ভাগে নিয়ে আসব। আমরা তো ভুলে যাই। বিদ্যুৎমন্ত্রীকে বলেছিলাম, প্রতিদিন যেন কিছু লোডশেডিং দেয়, তাহলে মানুষের মনে থাকবে যে লোডশেডিং আছে। পয়সা খরচ করে তেল কিনে জেনারেটর চালাতে হবে। তখন আক্কেলটা ঠিক হবে, না এই অবস্থা তো ছিল! তিনি বলেন, বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব। ইলেকশনের পর যদি আসতে পারি, তাহলে আবার করব। সব গুছিয়ে দেয়ার পর এখন ইলেকশনের কথা, ভোটের কথা, অর্থনীতির পাকা পাকা কথা শুনতে হয়। আমি এসব শুনতে রাজি নই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার ৭৭ বছর বয়স। ১৫ বছর বয়স থেকে মিছিল করি। এ পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে হারিয়েছি। আমি এখানে কিছু পেতেও আসিনি, নিতেও আসিনি। আমি এসেছি দেশের মানুষকে দিতে। আজ দেশ একটা মর্যাদা পাচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী। আগে বাংলাদেশ শুনলে সবাই নাক সিটকাতো। এখন বাংলাদেশ শুনলে আলাদা মর্যাদা দিয়ে তাকায়। উন্নয়নের রোল মডেল এটা মাথায় রাখতে হবে। এটা বাতাসে হয়নি। এটা আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলে, দেশের উন্নতি করেছি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছি।
তিনি বলেন, এখন কেউ না খেয়ে কষ্ট পায় না। মানুষের খাবার গ্রহণ বেড়েছে। আমাদের উৎপাদনও বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী কিন্তু প্রচণ্ড খাদ্যমন্দা। কেউ বলবে, কেউ বলবে না। আমি নিজে কয়েকটা দেশ দেখলাম। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রতিটি জায়গায়ই ইনফ্লেশন অনেক বেশি। কাজেই আমাদের খাদ্য আমাদের উৎপাদন করতে হবে।
পাঙাশ মাছের উদ্বৃতি টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন বলে দিলেন পাঙাশ মাছ খেতে পারেন না। আমি যদি জিজ্ঞাসা করি ২০০৯ বা ১৯৯৬ সালের আগে কে কত পাঙাশ মাছ খেয়েছেন। এই মাছ আগে বরিশাল আর যমুনা নদীতে পাওয়া যেত। সারা দেশে পাওয়া যেত না। গবেষণার মাধ্যমে এটি চাষ হয় এবং সারাদেশে পাওয়া যায়। যেখানে মানুষ নুনভাতের জন্য হাহাকার করত। ফেন চাইত, ?নুনভাত চাইত, সেখানে মানুষ মাছ মাংস ডিম খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে পারে। এইটুকু মানুষের জন্য করতে পারছি, আমি ওইভাবে দেখি। আমাদের যতটুকু সাধ্য ছিল তা করে দিয়েছি।
এ সময় ডেঙ্গু সচেতনতায় সবাইকে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘরবাড়ি, ছাদ থেকে শুরু করে আশপাশের অঞ্চলেও প্রত্যেকটা এলাকাভিত্তিক সবাই যদি একটু উদ্যোগ নেয় তাহলে ডেঙ্গুর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অবশ্যই প্রচেষ্টা আছে, প্রচেষ্টা চলছে। গবেষণাও চলছে। ইতোমধ্যে শুনলাম জাপান নাকি একটা টিকা আবিষ্কার করেছে। এগুলি তো সময়সাপেক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।