সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার সুতা, গজ ব্যান্ডেস, তুলা, গ্লোবস ও ক্যাথিটার হজম করছে কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা। এরইমধ্যে সব থেকে বেশি লুট হচ্ছে ক্যাটগার্ড ও ভিকরিল সুতা। অথচ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের জোরালো নির্দেশনা রয়েছে বিনামূল্যের চিকিৎসা সামগ্রী রোগীদের সঠিকভাবে বন্টনের জন্য। কিন্তু কতিপয় ওয়ার্ড বয় এনির্দেশ না মেনে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। দরিদ্র রোগীদের অর্থবাণিজ্য হলো তাদের মূল টার্গেট। সব থেকে বেশি লুটপাট হয় অপারেশন থিয়েটার, জরুরি বিভাগ ও প্লাস্টার কক্ষে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারিভাবে অপারেশন থিয়েটারে ক্যাটগার্ড, প্রলিন ও ভিকরিল সুতা সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু রোগীর অপারেশনের মাঝ পথে সেখানে কর্মরত কর্মচারি ও সেচ্ছাসেবকরা সুতার নাম লিখে দিয়ে বাইরে থেকে কিনে আনতে রোগীর স্বজনদের হাতে সর্ট স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছেন। সব থেকে বেশি লুট করা হচ্ছে সিজারিয়ান রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে। সুতা সরকারিভাবে সরবরাহ করা হলেও সেখানে দায়িত্বরত কর্মচারিরা রোগীর স্বজনদের সুতা কিনতে বাধ্য করছেন। পরে কর্মচারি ও সেচ্ছাসেবকরা ওই সুতা হাসপাতালের সামনে বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি করে থাকেন। প্রতিদিন এ হাসপাতালে ৮/১০ জন রোগীকে সিজারসহ বিভিন্ন অপারেশন করানো হয়। ক্যাটগার্ড ও ভিকরিল সুতার বাজার মূল্যে তিনশ’ থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন সুতা থেকেই এ বিভাগের অসাধু কর্মচারি ও সেচ্ছাসেবকরা লুট করে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। হাসপাতালের প্লাস্টার কক্ষ, সার্জারি বিভাগের অপাশেরশন থিয়েটার ও জরুরি বিভাগে মুখ চিনে দেয়া হয় সুতা ও গজ ব্যান্ডেস। জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মোফাজ্জেল হোসেন নিশ্চিত করেছেন সেখানে ক্যাটগার্ড সুতা সরবরাহ আছে। তবে, এখান থেকে কেউ এই বিনামূল্যে সুতা পেয়েছেন তার কোনো নজির নেই। সাধারণত জরুরি বিভাগ থেকে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আগত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও ছোট—খাটো সার্জারি করানো হয়।
রোগী আসা মাত্রই তাদের জানানো হয়, হাসপাতালের সুতা দিয়ে সেলাই দিলে দাগ হয়ে থাকবে। পরে তাদের যেনো কোনো দোষ না দেয়া হয়। দাগ মুক্ত ও ভালো সেলাই পেতে হলে অবশ্যই বাইরে থেকে উন্নতমানের সুতা কিনে নিয়ে আসতে হবে। তবে, এই সুতা তাদের কাছ থেকে কিনলে ফার্মেসির থেকে একশ’ টাকা কমে পাওয়া যাবে। বাইরে চারশ’ টাকা হলেও তারা তিনশ’ টাকা রাখতে পারবেন। পরে সরকারি সুতা দিয়ে সেলাই করে হাতিয়ে নেয়া হয় টাকা। শুধু তাই নয়, রোগীর প্লাস্টারের প্রয়োজন হলে কৌশলে রোগীর স্বজনদের কাছে প্লাস্টার সামগ্রী বিক্রি করেন। বিনামূল্যের মালামাল দিয়ে পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়া হয় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে। অথচ হাসপাতাল থেকে এ সব মালামাল সরবরাহ করা হয় জরুরি বিভাগে। এভাবে প্রতিদিন জরুরি বিভাগ থেকে কর্মচারি ও সেচ্ছাসেবকরা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লুট করছে।
হাসপাতালের ফার্মেসির সামনে অবস্থিত প্লাস্টার কক্ষ দুর্নীতির শীর্ষে থাকলেও অজ্ঞাত কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছেন কতৃর্পক্ষ। প্রতিদিন অর্ধশত মানুষ এখান থেকে সেবা নেয়। রোগী আসা মাত্রই তাদের জানানো হয় এখানে সরকারি কোনো কিছুই সরবরাহ নেই। তারা সকলেই সেচ্ছাসেবক। প্লাস্টার করাতে হলে মালামাল বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে হবে ও তাদের কিছু বকশিস দিতে হবে। আর যদি তারা মালামাল সরবরাহ করে তাহলে খরচ কম হবে আর বকশিসও দিতে হবে না। এক্ষেত্রে রোগী প্রতি আদায় করা হয় দুইশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ কক্ষ। বাড়ি ফেরার সময় এ টাকা সকল কর্মচারি সমান ভাগে ভাগ করে নিয়ে চলে যায়। আর সামান্য কিছু জমা করে সরকারি কোষাগারে। প্রতিদিন এ কক্ষ থেকে উপার্জন হয় পাঁচ/ছয় হাজার টাকা।
জরুরি বিভাগ থেকে মারপিট, সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভন্ন ভাবে জখম রোগীদের পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানেও কোনো কিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে কিনে রোগীর সেবা নিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড, পুরুষ ও মহিলা পেয়িং ওয়ার্ড, মডেল ওয়ার্ড, লেবার ওয়ার্ড, গাইনী ওয়ার্ড, সংক্রামক ওয়ার্ড এবং শিশু ওয়ার্ডে প্রয়োজন মতো গজ, ব্যান্ডেজ,তুলা, গ্লোবস ও ক্যাথিটার সরকারিভাবে সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীর ভাগ্যে জোটেনা তা। রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসার জন্য ওয়ার্ডে আসলেই দায়িত্বরত সেবিকা ওষুধ সামগ্রী লিখে একটি ছোট কাগজ ধরিয়ে দেন স্বজনের হাতে। অনেক সময় তারা প্রশ্ন করলেও বলা হয় এখানে মালামাল সরবরাহ নেই। পরে সেচ্ছাসেবকরা সরকারি মালামাল দিয়ে সেবা দেন আর রোগীর স্বজনদের কেনা মালামাল পরে বাইরে বা অন্য রোগীর কাছে বিক্রি করে দেন। যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিন দিনব্যাপী অনুসন্ধানকালে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
এদিকে অনুসন্ধানকালে তানভির ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন জানান, তার স্ত্রী দু’দিন আগে সিজারিয়ান হয়েছে এ হাসপাতাল থেকে। পরে তাকে দিয়ে অপারেশন কক্ষের কর্মচারিরা সুতা, ব্লেড, সাবান, হ্যান্ড গ্লোবস কিনেছেন। এসব কি হবে জানতে চাইলে কর্মচারিরা বলেন, এতো বেশি বুঝলে এখানে রোগীর অপারেশন হবে না। পরে তিনি এসব মালামাল কিনতে বাধ্য হন। মোল্ল্য অবায়দুর রহমান নামে একজন রোগীর স্বজন জানান, তার ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাত ভেঙে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন। সেখান থেকে ড্রেসিং, ব্যান্ডেজ ও সেলাই বাবদ তিনশ’ টাকা হাতিয়ে নেন কর্মচারীরা।
মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন বিউটি বেগম জানান, হঠাৎ পড়ে যেয়ে তার মাথা কেটে গেছে। প্রতিদিন ড্রেসিং করতে গজ ও ব্যান্ডেজ বাবদ একশ’ টাকা করে দিতে হচ্ছে কর্মচারীদের। তার মতো একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার সুতা, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, গ্লোবস ও ক্যাথিটার কেনার কথা বলে কর্মচারি ও সেচ্ছাসেবক নামধারী একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ।
হাসপাতালের স্টোর কিপার সাইফুল ইসলাম রুপান্তর প্রতিদনকে জানান, জরুরি বিভাগ ও অপারেশন কক্ষ থেকে চাহিদাপত্র পাওয়া মাত্র মালামাল হস্তান্তর করা হয়। বিভিন্ন প্রকার সুতা হাসপাতালে মুজদ আছে। রোগীদের না পাবার কোনো সুযোগ নেই।
এ সব বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হারুন অর রশিদ রুপান্তর প্রতিদিনকে জানান,এধরনের কিছু দুষ্ট কর্মচারিকে বাদ দিয়েছি তবে ডেঙ্গুর প্রভাবে পুনরায় ওদেরকে নিতে হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনে আসলে তাদেরকে বাদ দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।