শৈলকুপায় নিখোঁজের ১১ ঘণ্টা পর শিশুর লাশ উদ্ধার

আগের সংবাদ

আশাশুনিতে নির্মাণের পাঁচ বছরের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়েছে ব্রীজ

পরের সংবাদ

জমে উঠেছে চৌগাছার পীর বলুহ দেওয়ানের মেলা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ , ৫:৩৪ অপরাহ্ণ আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ , ৭:২৪ অপরাহ্ণ

যশোরের চৌগাছার ঐতিহ্যবাহী হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ানের মেলা জমে উঠেছে। যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার থেকে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ দিনের জন্য মেলার অনুমতি দিয়েছেন। এছাড়া তিন দিন চলবে ওরস। বুধবার দুপুরে মেলার বাজারে গিয়ে দেখা যায় মেলা ঘিরে গোটা এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

এরআগে সোমবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান শাহিনকে আহবায়ক, নারায়ণপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনকে সদস্য সচিব এবং হাজরাখানা গ্রামের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলনকে কোষাধ্যক্ষ করে ১৬ সদস্যের মেলা পরিচালনা কমিটি করে দেয়া হয়েছে। এর আগে নারয়াণপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান শাহিনকে আহবায়ক, আবুল হোসেন, মনিরুজ্জামান মিলন ও মাজার কমিটির সভাপতি আশাদুল ইসলামকে যুগ্ম আহবায়ক এবং ইউনিয়ন ভূমিসহকারী কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে ওরস পরিচালনা কমিটি করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা।

অনুমোদনের পর সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং পীর বলুহ দেওয়ানের মাজার ধৌত করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ওরস এবং মেলার শুরু হয়েছে। মেলা পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে করা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং চৌগাছা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) জেল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল মেলার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দেখভাল করছেন।

বুধবার সরেজমিনে মেলায় গিয়ে দেখা যায় কপোতাক্ষের পাড়ে পীর বলুহ দেওয়ানের মাজারের পূর্ব পাশ থেকে শুরু করে গ্রামের বলুহর দরগাহ থেকে চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত এবং গ্রাম থেকে চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের যাত্রী ছাউনি পর্যন্ত দুটি পাকা রাস্তার দুই ধারে, গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাাশ, হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসার চারপাশ ও গ্রামের খোলা জায়গায় বসেছে মেলার বাজার।
মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও শুক্রবার থেকেই দোকানীরা দোকান সাজিয়ে বসেছেন। বিক্রিও শুরু হয়েছে তখন থেকেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে মেলায় প্লাস্টিক, কাঠ ও স্ট্রিলের আসবাবপত্র, খেলনা, প্রসাধনী, গার্মেন্টস, হোটেল-বেকারি, মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা, এ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী, ক্রোকারিজ, স্ট্রিলের নানা সামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ শতাধিক দোকান বসেছে। এছাড়াও শিশুদের নাগরদোলা, ট্রেন ভ্রমণ, আকাশ ভ্রমণসহ নানা আকর্ষণীয় আয়োজন রয়েছে মেলায়।

প্রতি বাংলাসনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) দরগাহ ঘিরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে এই মেলা। হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর এ অঞ্চলের পীরে কামেল বলুহ দেওয়ান (রহ) এর রওজা শরীফ অবস্থিত। মেলার সময় এলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পড়ে যায় ব্যস্ততার ধুম। এ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই দাওয়াত করার রেওয়াজ রয়েছে।

রূপান্তর: সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং পীর বলুহ দেওয়ানের মাজার ধৌত করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ওরস এবং মেলার শুরু হয়েছে।

যাকে ঘিরে এই মেলা তার সম্পর্কে রয়েছে নানা মিথ। লোক মুখে প্রকাশ পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ‘তিনি যা বলতেন তাই হতো।’ তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেষ্ঠ ভক্তদের মতে ‘তিনি ৩-৪ শ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।’

তবে জেষ্ঠ সাংবাদিক নাসির হেলালের লেখা ‘যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার’ এবং সাংবাদিক মাসুদ পারভেজের লেখা ‘চৌগাছার পীর-দরবেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আনুমানিক ষোড়’শ শতাব্দির প্রথমদিকে তিনি জন্মগ্রহন করেন। গ্রন্থদুটি থেকে জানা যায় বলুহ (রহ) এর নামে ভারতের কলকাতা ও নদীয়া, বাংলাদেশের চৌগাছার হাজরাখানাসহ বিভিন্ন স্থানে ৫২টি থান (ইবাদতগাহ) আছে। যেখানে তার ভক্তরা বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন। বর্তমানে উপজেলার জিওলগাড়ি, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়-ধোপাধী গ্রামে তার থানে ছোট পরিসরে মেলা বসে থাকে। তার নামে চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) দাখিল মাদরাসার নামকরণ করা হয়েছে।

পীর বলুহ (রহ) সম্পর্কে মিথ প্রচলিত আছে, ‘যখন তাঁর বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার নির্দেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেতের মালিক গরুগুলি ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।’ পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন শরিষা পোড়েনি।’ ‘একদিন তার মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুনে জ্বাল দিতে থাকেন। এতেও তাঁর পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি।’ এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তাঁর নিকট এসে শিষ্যত্ব নেন। ‘অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।’

তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর নামে মানত করতে থাকে। মানত পরিশোধে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখানা গ্রামে অবস্থিত তাঁর রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। সেখান থেকেই একসময় ভক্তদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে জমজমাট মেলা। প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা শুরু হয়ে ৩ থেকে সাত দিন মেলার আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মেলা শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্ব থেকে শেষের ১০/১২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে মেলার বেচাকেনা।

একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানী ও দর্শনার্থী হতাহত হয়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেলাচলাকালীন চৌগাছা শহরে উপজেলা আওয়ামী লীগের অফিসে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা ও গুলিতে খুন হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল। পরে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ায় সে পরিবেশ পাল্টে গেছে।

মেলায় সারা দেশ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন ব্যবসা করতে। এ অঞ্চলের যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ২০/৩০ টি উপজেলার মানুষ আসেন মেলা দেখতে এবং মেলা থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করতে। কপোতাক্ষ নদের তীর থেকে হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত এ মেলা আয়াতন ও পরিধিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরেক বিখ্যাত সাতক্ষীরার গুড়পুকুরিয়ার মেলা থেকেও বৃহৎ এবং আকর্ষণীয়।

প্রতি বছর স্থানীয়রা একটি কমিটি গঠনের পর স্থানীয় এমপির সুপারিস সহকারে জেলা প্রশাসকের নিকট মেলার অনুমোদনের আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌগাছা থানার ওসির কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে মতাতম নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। তবে চলতি বছর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান শাহিনকে আহবায়ক এবং গ্রামের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলনকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি এবং অপরপক্ষ স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিওর মাধ্যমে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনকে আহবায়ক এবং মালেশিয়া প্রবাসী কামরুজ্জামান শিমুলকে সদস্য সচিব করে পাল্টাপাল্টি কমিটি মেলার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করায় জটিলতার সৃষ্টি হয়। পরে সোমবার রাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুইপক্ষের সমন্বয়ে মেলা পরিচালনা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়।

এসএমরা/জেআ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়