সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্রের পিছু হটা এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান নিয়ে অনেকের মধ্যে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এবং এর সংগত কারণও আছে। আমাদের কাছে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান থেকে শুরু করে ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসক হওয়ার পথে আছেন এমন লোকদের একটি বাড়ন্ত তালিকা আছে। এরা ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের এক অদ্ভুত চেহারা ধারণ করেন। তারা সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষা এবং দীর্ঘদিনের জাতীয় মূল্যবোধ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। বাস্তবে তারা এমন নীতি নেন, যা ক্ষমতাবানদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের রীতিনীতিকে ধ্বংস করে। এদিকে আমরা বাকিরা তাদের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাখ্যার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকি।
এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে যেটি অপেক্ষাকৃত বেশি প্রচলিত তা হলো, বৈষম্য বৃদ্ধি। এটি নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদ থেকে জন্মানো এক সমস্যা। গণতন্ত্রের ক্ষয়ের সঙ্গেও বহুভাবে এর সম্পর্ক দেখানো যেতে পারে। অর্থনৈতিক বৈষম্য অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়, যদিও দেশের সর্বত্র তা সমান মাত্রায় ঘটে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও, যেখানে প্রচার চালানোয় কার্যত কোনো বাধা নেই, সেখানেও ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ ইতোমধ্যে ‘এক ডলার এক ভোট’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
এই রাজনৈতিক বৈষম্য আবার নিজে থেকে শক্তিশালী হয়। পরিণামে তা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও গভীর করার নীতির জন্ম দেয়। এ ব্যবস্থায় করনীতি হয় ধনীদের পক্ষে; শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের পক্ষে কাজ করে। বাজেভাবে প্রণীত ও বাস্তবায়িত অ্যান্টিট্রাস্ট আইন করপোরেশনগুলোকে বাজারের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে এবং তা অপব্যবহারের লাগামহীন সুযোগ দেয়। তার ওপর গণমাধ্যম যেহেতু রুপার্ট মারডকের মতো প্রতাপশালী ধনী তথা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর বিত্তবানদের কোম্পানিগুলোর অধীন, মূলধারার আলাপ-আলোচনাও তারা নিয়ন্ত্রণ করে। সংবাদ ভোক্তাদের এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে, ধনীদের ওপর কর বসানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষতি করে ইত্যাদি।
অতি সম্প্রতি অতি ধনীদের কবজায় থাকা ঐতিহ্যবাহী মিডিয়াগুলোর এমন অপপ্রচারে তাদেরই হাতে থাকা যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মও যোগ দিয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভুল তথ্য ছড়াতে আরও বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে।
জবাবদিহিহীন পুঁজিবাদের এ যুগে লোকে যখন সম্পদের ক্রমবর্ধমান পুঞ্জীভবনকে সন্দেহের চোখে দেখছে, অথবা তারা বিশ্বাস করে যে সিস্টেম বেদখলের শিকার; তখন কি অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকে? গণতন্ত্রের এ অন্যায্য ফল সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটাই গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল করেছে। কেউ কেউ আবার এসব থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে যে, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আরও ভালো ফল দিতে পারে।
এটি একটি পুরোনো বিতর্ক। ৭৫ বছর আগে লোকের ভাবনা ছিল, গণতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী শাসনের মতো দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারে কিনা তা নিয়ে। এখন প্রশ্নটা হয়ে গেছে এমন– কোন সিস্টেমটি বৃহত্তর ন্যায্যতা দান করে? মনে রাখতে হবে, এই বিতর্ক এমন একটি বিশ্বে মাথাচাড়া দিচ্ছে, যেখানে খুব ধনী ব্যক্তিদের কাছে জাতীয় ও বৈশ্বিক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম রয়েছে। কখনও কখনও তারা একেবারে ডাহা মিথ্যাও প্রচার করতে পারে।
এসবের ফল হিসেবে সমাজে গভীর মেরূকরণ ঘটছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে নির্বাচন মানেই সবকিছু যাবে শুধু বিজয়ীর অধিকারে, সেখানে এই মেরূকরণ গণতন্ত্রের কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ২০১৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে কম ভোটে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার সময় আমেরিকান রাজনীতি, যা এক সময় সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে ছিল– একটি চাঁছাছোলা পক্ষপাতদুষ্ট ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। এটি এমন একটি কুস্তি খেলা, যেখানে মনে হয় অন্তত একটি পক্ষ বিশ্বাস করে, খেলায় কোনো নিয়ম থাকা উচিত নয়।
মেরূকরণ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, কোনো কিছু মেনে নেওয়ার খেসারত খুব বাজেভাবে দিতে হতে পারে। তাই উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা জায়গা খোঁজার বদলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যে কোনো মূল্যে নিজস্ব অবস্থান পোক্ত করায় মনোযোগী হন। রিপাবলিকানরা প্রকাশ্যে ভোটার উপস্থিতি কমানোর পাশাপাশি জাল-জালিয়াতি করে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে সেটাই করেছিল।
গণতন্ত্র তখনই সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা খুব কমও না, আবার বেশিও না (যদি তা খুব কম হয়, মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার তাগিদ সামান্যই থাকে)। এমন ব্যবস্থার অবশ্য অভাব নেই, যেখানে গণতন্ত্রকে একটা স্বস্তিকর মাধ্যমের পর্যায়ে উন্নীত করা যায়। যেমন সংসদীয় ব্যবস্থাগুলো জোট গঠনকে উৎসাহিত করে এবং প্রায়ই চরমপন্থিদের বদলে মধ্যপন্থিদের ক্ষমতা দেয়। যে ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ভোট দিতে হয় এবং ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীদের একটা তালিকা তৈরির সুযোগ পায়, সে ধরনের ব্যবস্থাও এমন গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হতে পারে। আবার একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও সুরক্ষিত সিভিল সার্ভিসের উপস্থিতিও এমন গণতন্ত্র উপহার দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে গণতান্ত্রিক আলোকবর্তিকা হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছে। যদিও সবসময় তাতে ভন্ডামি ছিল; অন্তত রোনাল্ড রিগানের অগাস্টো পিনোশেকে কোলে তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে জো বাইডেনের সৌদি আরব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে না পারা অথবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের মুসলমানবিরোধী উগ্রতাকে নিন্দা করতে ব্যর্থ হওয়া পর্যন্ত; যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ ধারার রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা করেছে।
কিন্তু এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য এতটাই বেড়েছে, অনেকে গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করছে। এটি কর্তৃত্ববাদের জন্য, বিশেষত ট্রাম্প ও বলসোনারোর মতো নেতারা যে ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার জন্য উর্বর ভূমি জোগাচ্ছে। তবে এ ধরনের নেতার কাছে অসন্তুষ্ট ভোটারদের সন্তুষ্ট করার উপায় নেই। ক্ষমতা পেয়ে তারা যে নীতিগুলো তৈরি করেন, তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।
বিকল্প খোঁজার পরিবর্তে আমাদের তাই নিজেদের সিস্টেমের দিকে তাকাতে হবে। সঠিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং করপোরেশন ও ধনী ব্যক্তিদের চেয়ে নাগরিকদের প্রতি আরও দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে। এ জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারও প্রয়োজন। আমরা ন্যায্যভাবেই সব নাগরিকের মঙ্গল নিশ্চিত করার কাজ শুরু করতে এবং জনতুষ্টিবাদীদের পালের হাওয়া কেড়ে নিতে পারি। তবে তা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা নব্য উদারতাবাদী পুঁজিবাদকে পেছনে ফেলে কাঙ্ক্ষিত অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধি সৃষ্টিতে মনোযোগী হবো।
জোসেফ ই স্টিগলিজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।