এক দিন পরই নয়াদিল্লি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে। এটা ভারতের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। শক্তিশালী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামে এ বছরের সভাপতি হিসেবে দেশটি কী করছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। এটা সত্য, এই পদ ভারতকে তার বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নে যেমন সহায়তা করেছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ গুরুতর কিছু বিষয় আড়ালেও ভূমিকা রেখেছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখনও অপেক্ষা করছে। জি২০ নেতা হিসেবে বিভক্ত সদস্যদের ঐকমত্য তৈরিতে নেতৃত্ব দিতে চেষ্টা করতে হবে নয়াদিল্লিকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেটা অধরাই থেকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটা প্রমাণ করতে চান– তাঁর নেতৃত্বে ভারত বৈশ্বিক পর্যায়েও পারঙ্গমতা দেখাতে যথেষ্ট সক্ষম। বিশেষ করে বিদেশে ও অভ্যন্তরে যে সমালোচনা রয়েছে– কূটনৈতিক দিক থেকে ভারতের ধার ও ভার কম; তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি। জি২০ প্রেসিডেন্টের পদ এ ক্ষেত্রে ভারতকে সহায়তা করেছে। চলতি সপ্তাহে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, গত বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে জি২০-এর সভাপতিত্ব পাওয়ার পর ভারত ৬০টিরও বেশি শহরে দুই শতাধিক বৈঠকের আয়োজন করেছে।
ভারত একই সঙ্গে ধনিক দেশ ও গ্লোবাল সাউথের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করার জন্য তার ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ভাবমূর্তি কাজে লাগাতে চায়। এ ক্ষেত্রে জি২০ নিঃসন্দেহে আদর্শ প্ল্যাটফর্ম। নয়াদিল্লি এ বছরের জি২০ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো অগ্রাধিকারে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈদেশিক ঋণ ইত্যাদি। এ বছরের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লি ‘ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট’ তথা গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রয়োজনের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা এবং আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি২০ সদস্যপদ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ভারত অবশ্যই জি২০ সভাপতির পদকে জনসংযোগের হাতিয়ার হিসেবে দেখে, যাতে দেশটি তার বৈশ্বিক প্রভাব বোঝাতে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে বিশ্বের চোখ অন্যদিকে সরাতে পারে। নয়াদিল্লিকে এ ক্ষেত্রেও সফল বলতে হবে। এ বছরের মে মাসে ভারত বিতর্কিত কাশ্মীরে জি২০ পর্যটন শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। ওই সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এ অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করা। যদিও প্রতিবাদস্বরূপ জি২০-এর বেশ কিছু সদস্য ওই সম্মেলনে যোগ দেয়নি।
জি২০ বা গ্রুপ অব টোয়েন্টি ফোরামের দায়িত্বের সুবিধা নিয়ে মোদি সরকার এ বছরের গ্রীষ্মে মণিপুর সহিংসতা থেকে এর সদস্যদের মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুরের নৃতাত্ত্বিক সংকট দীর্ঘদিনের। একই সঙ্গে সম্প্রতি নয়াদিল্লির কাছে গুরগাঁওয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অন্তত ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সেটিও ভারত আড়ালে নিতে সক্ষম হয়েছে।
জি২০ সভাপতি হিসেবে ডিসেম্বরে ভারতের মেয়াদ শেষ হবে। নয়াদিল্লির সত্যিকার সফলতা এই জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমেই পরিমাপ করা হবে। সম্মেলনে জি২০ সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিবৃতি দেয় কিনা, তা থেকেও বোঝা যাবে এটা কতটা সফল। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যও ভারত গর্ব বোধ করে। যদিও জি২০ ঘিরে বড় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যে অঘোষিত প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে, তার ফলে সম্মেলনপরবর্তী বিবৃতিতে সব সদস্যের স্বাক্ষর নেওয়াটা মুশকিল হবে।
ফ্রান্স ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা না জানালে তারা স্বাক্ষর করবে না। অন্যদিকে এমন কোনো বিবৃতি দেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া স্বাক্ষর করবে না। এমনকি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতির কারণে সবার ঐকমত্যের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ। এই দু’জনের অনুপস্থিতিতে যারা তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাদের কোনো ধরনের আপস কিংবা ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এর সঙ্গে আরও যোগ করার বিষয় হলো, ভারতের নেতৃত্বাধীন যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ জি২০ বৈঠক হয়েছে, সেগুলোতে এ পর্যন্ত কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা যায়নি।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের সবচেয়ে বড় আশা, কম বিতর্কিত বিষয়ে সম্মিলিত বিবৃতি প্রদান। যেমন আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যপদ সমর্থন করা, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া, ক্লিন এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদি। গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের বিবৃতিতে যেটা দেখা গেছে, মতবিরোধের ক্ষেত্রগুলোতে সব সদস্যের পরিবর্তে বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ সদস্য’ তাতে সম্মত।
এবারের জি২০ সম্মেলনে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি হতে পারে মতবিরোধের জের ধরে যৌথ বিবৃতিই প্রকাশ করতে না পারা। এটা ভারত বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির জন্য একটা ধাক্কা বলে বিবেচিত হবে। কারণ জি২০ সভাপতি পদে তিনি ব্যাপক রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের এবং ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির প্রতীক পদ্ম এবার জি২০ সম্মেলনের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে সম্মেলনটির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি যুক্ত হয়ে গেছে। ভারত ও মোদির অনেক কিছুই যেখানে বাজি ধরা হয়েছে, সেখানে ব্যর্থতার কোনো সুযোগই থাকতে পারে না। কিন্তু সফলতাও সহজে আসবে বলে মনে হয় না।
মাইকেল কুগেলম্যান: ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক; ফরেন পলিসি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।