বরিশাল সিটিতে ৪০ কাউন্সিলর পদের ২৯টিতে আ’লীগের প্রার্থী জয়ী

আগের সংবাদ

জন্ম ১৯৭০ সালে, এসএসসি পাস ১৯৭৫ সালে!

পরের সংবাদ

বরিশাল সিটির আয় নেই তবু মেয়রের বিলাসিতা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ , ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ , ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ

অন্যান্য সিটি করপোরেশনের তুলনায় আয় ও সরকারি বরাদ্দে অনেক পিছিয়ে বরিশাল। টাকার টানাটানি চললেও বন্ধ নেই অপচয় কিংবা বিলাসিতা। বরিশাল রাজস্ব আয়ে সমবয়সী সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রায় সমান হলেও, সরকারি বরাদ্দ প্রাপ্তিতে যোজন দূরে। এক দশক পর গঠিত রংপুর, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনও এগিয়ে বরিশালের চেয়ে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজস্ব আয় থেকে বেতন-ভাতা ও দৈনন্দিন খরচ মেটানোর পর গত অর্থবছরে বরিশাল সিটি করপোরেশনের হাতে উন্নয়নের জন্য ছিল যথাক্রমে ৪০ কোটি এবং এর আগের বছর ছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। ৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বরিশাল নগরীর ছয় লাখ নাগরিকের পরিষেবা উন্নয়নের কাজ হয়েছে এই সামান্য টাকায়।  কিন্তু তা ব্যয়েও রয়েছে অস্বচ্ছতার অভিযোগ। নিজস্ব অর্থায়নের উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্র ও ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে সিটি করপোরেশনগুলো। বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠরা পেয়েছেন ঠিকাদারি কাজ। রাজস্বের টাকার অপচয় করা হয়েছে মেয়রের অনুগতদের অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। তাঁর ফেসবুক লাইভের কাজে খাটানো হয়েছে করপোরেশনের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের। নগর ভবনে কার্যালয় থাকলেও বর্ধিত ভবনে বিলাসবহুল অফিস বানানো হয়েছে মেয়রের জন্য। মহাসড়কে ৬ কোটি টাকায় বানানো হয়েছে পার্ক। অযত্নে নষ্ট হয়েছে মেয়রের জন্য বরাদ্দ পাজেরো গাড়ি।

অন্য সিটির বাজেটে পিছিয়ে, সরকারি বরাদ্দও পায় না  ২০০২ সালে গঠিত হয় বরিশাল সিটি করপোরেশন। এর এক বছর আগে গঠিত হয় সিলেট সিটি করপোরেশন। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরিশালের বাজেট ৪১৯ কোটি টাকা। সিলেটের বাজেট বরিশালের প্রায় আড়াই গুণ– ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে কুমিল্লা এবং পরের বছর রংপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ওই সময় কুমিল্লার বাজেট ৬৮২ কোটি ও রংপুরের ৩৮০ কোটি টাকা।

আগের বছরগুলোর হিসাব বলছে, বরিশালে বাজেট বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৪১৫ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয় ২৯৬ কোটি টাকা। এবারও বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়া নিশ্চিত।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ একতরফা জয় পান। তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে। তিনি বরিশাল-১ আসনের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিরীক্ষা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বেও রয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে সাদিক আবদুল্লাহ সরকারের প্রকল্প ও বরাদ্দ বেশি পাবেন– গত নির্বাচনের সময় এ ধারণাই ছিল। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন চিত্র। সিলেটে বিএনপির এবং রংপুরে জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়ররা বেশি পেয়েছেন।
বরিশালের চলতি বাজেটে সরকারি ও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে আয় ধরা হয়েছে ২৩৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আগের বছরে ২১১ কোটি ধরা হলেও পায় ১৬৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। বরিশালে সরকারের মাত্র একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।

কুমিল্লা সিটির চলতি বছরের বাজেটে সরকারি বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫৬৮ কোটি টাকা। আগের বছর পেয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। ওই সময় কুমিল্লার মেয়র ছিলেন বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু। একই অর্থবছরের ১১ মাসে বরিশাল পায় ২৫ কোটি টাকা। তার আগের বছর পেয়েছে ৭৬ কোটি টাকা।
গত ছয় বছর রংপুরের মেয়রের চেয়ারে রয়েছেন জাপার মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। গত অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে ১১৪ কোটি টাকা পেয়েছে রংপুর। সিলেট সিটিতে ১০ বছর ধরে মেয়র পদে রয়েছেন বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেটের চলতি বাজেটে সরকারি বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭২৬ কোটি টাকা। আগের দুই বছরে সরকারের কাছ থেকে ৩৮৬ এবং ২৯০ কোটি টাকা পেয়েছে সিলেট, যা বরিশালের কয়েক গুণ।

নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়নের সামর্থ্য নেই
নগরবাসীর কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন কর তথা রাজস্ব আয়েও পিছিয়ে বরিশাল। চলতি বছর রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি টাকা। আগের বছরে আয় ছিল ৮০ কোটি টাকা। একই বছর সিলেটের আয় ছিল ৮৯ কোটি টাকা। গত বছর বরিশালে মেয়র-কাউন্সিলদের সম্মানী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পরিষেবায় খরচ হয় সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা। নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়নের জন্য অবশিষ্ট থাকে ৪০ কোটি টাকা। এর আগের বছর ছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। ফলে নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়নের সামর্থ্য নেই বরিশাল সিটির।
আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটিতে ভোট। এবার সাদিক আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দল প্রার্থী করেছে তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লহকে। অন্যান্য সিটির তুলনায় বরিশাল সরকারি বরাদ্দ না পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো তিনিও মেয়র সাদিককে দায়ী করেছেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘বরিশাল থেকে গত পাঁচ বছরে সরকারের কাছে প্রকল্প পাঠানো হয়নি। কীভাবে বরাদ্দ আসবে? বিদেশি দাতা সংস্থার সাহায্যও কাজে লাগানো যায়নি। টাকা কেউ দিয়ে যাবে না। সে (সাদিক) মনে করেছে, তাকে দিয়ে যাবে।’

টানাটানির সংসারেও অপচয়
টাকার অভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকার সড়ক সংস্কার হচ্ছে না। নেই পানির সংযোগ। কিন্তু বাসিন্দাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে পানির বিল। বর্ধিত এলাকার ৭ ওয়ার্ডে সব সড়ক ভেঙেচুরে একাকার। নাগরিক সেবা দিতে না পারলেও ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কের একাংশ বন্ধ করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) জমিতে সোয়া ৬ কোটি টাকায় মেয়রের প্রয়াত মা সাহান আরা বেগমের নামে পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে।
২৪ ফুটের মহাসড়কটি প্রশস্ত করে ৪৮ ফুটে উন্নীত করার কাজ চলছে। ফলে ভাঙা পড়বে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা পার্কটি। বরিশাল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহমুদ সুমন সমকালকে জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবহিত রয়েছে। পার্ক ভাঙা হবে কিনা– এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বিলাসিতা, অবহেলায় সম্পদ নষ্ট
মেয়রের জন্য বরাদ্দ করপোরেশনের পাজেরো গাড়ি সাদিক আবদুল্লাহর কালীবাড়ি রোডের বাসায় সাড়ে চার বছর ধরে পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। এক দিনও গাড়িটি ব্যবহার করেননি মেয়র। করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) স্বপন কুমার রোহান বলেন, মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সময় কোটি টাকায় কেনা গাড়িটি বর্তমান মেয়রের বাসায় রয়েছে। দীর্ঘ বছর ব্যবহার না করায় বিকল হয়ে পড়েছে।

সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনের বড় একটি সময় ফেসবুক লাইভে থাকতেন মেয়র সাদিক। লাইভ সম্প্রচারের কাজে খাটতেন করপোরেশনের কর্মচারীরা। দৈনিক মজুরি খাত থেকে তাঁদের বেতন দেওয়া হয়। মেয়র ঢাকায় বা বিদেশ গেলেও তাঁরা সঙ্গী হতেন। প্রাশাসনিক কর্মকর্তা বলেছেন, তিন-চারজন অস্থায়ী কর্মচারী লাইভের কাজ করতেন।
নগর ভবনে রয়েছে মেয়রের কার্যালয়। কিন্তু নগরীর বিবিরদীঘির পাড়ের সাবেক পৌর ভবন (অ্যানেক্স বিল্ডিং) পুনর্নির্মাণ করে সেখানে আরেকটি বিলাসবহুল অফিস করা হয়েছে। নগরের ভবনে যেতেন না সাদিক আবদুল্লাহ। অ্যানেক্স ভবনে যেতেন মাঝেমধ্যে। বাসায় দাপ্তারিক কাজ করতেন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মেয়রের বাসায় ভোররাত পর্যন্ত থাকতেন। মেয়রের বাসভবনে হতো করপোরেশনের সাধারণ সভা।

করপোরেশনের কর্মচারীদের দলীয় কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে। নগরীর সদর রোডে আওয়ামী লীগের স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় বছরখানেক আগে। ভিত্তিপ্রস্তরটি তখন থেকে ২৪ ঘণ্টা পালা করে পাহারা দিচ্ছেন করপোরেশনের কর্মচারীরা।

অনুগতদের অস্থায়ী নিয়োগ, কাজে মেয়রের সঙ্গে থাকা
মেয়রের ‘খলিফা’ হিসেবে পরিচিত ছয়জনের তিনজনকে করপোরেশনে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেন সাদিক আবদুল্লাহ। মহানগর ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক রইজ আহমেদ মান্না স্বাস্থ্য শাখায়, জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব হোসেন খান স্টোর শাখায় ও সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত ওবায়দুল হক সড়ক পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পান। তবে তাঁরা থাকতেন মেয়রের সঙ্গে। বরিশালে ভবন নির্মাণ ও জমি ভরাটের কাজ শুরু হলে ‘জরিমানা’ আদায়ে হাজির হতেন।

গত ডিসেম্বরে উপনির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগে রাজিব খান কর্মচারী পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে অংশ নিতে চাকরি ছেড়েছেন রইজ আহমেদ মান্না ও সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত। বরিশালের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল মেয়রের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতেন রইজ আহমেদ মান্না। ঢাকা-বরিশাল রুটে বিএমএফ ও ইলিশ পরিবহন নামের দুটি কোম্পানির কাউন্টার ছিল তাঁর। বিএমএফ কাউন্টারে দায়িত্ব পালন করতেন সংরক্ষিত ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সচিব ফরিদ হোসেন রনি। তিনি সমকালকে বলেন, ওয়ার্ড কার্যালয়ের দায়িত্ব ফেলে নয়, কাউন্টারে মাঝে মাঝে যেতেন।

মেয়রের অনুগতরা ঠিকাদার, নিয়ম ভেঙে টাকা প্রদান
করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পে একচেটিয়া ঠিকাদারি কাজ করেছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এম খান লিমিটেড সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মেয়র ঘনিষ্ঠ মাফফুজ খান। মেয়রের অনুগত হিসেবে পরিচিত নিরব হোসেন টুটুলের মাহিমা এন্টারপ্রাইজ এবং তানিশা এন্টারপ্রাইজের মালিক। এই দুই প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারি কাজ প্রাপ্তিতে রয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে।

নির্বাচনী ম্যানুয়েলের ২৪(৩) ধারা অনুযায়ী, তপশিল ঘোষণার পর মেয়র বা অন্য কোনো পদধারী নতুন প্রকল্প অনুমোদন এবং ইতোপূর্বে অনুমোদিত প্রকল্পে টাকা অবমুক্ত বা প্রদান করতে পারবেন না। তবে গত মাসে তপশিলের পর মেয়রের সইয়ে মাহিমা এন্টারপ্রাইজকে ৩ কোটি ১১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং তানিসা এন্টারপ্রাইজকে ১ কোটি ৮০ লাখ ৪৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছে।
তবে এ বিষয়ে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। বক্তব্যের জন্য করপোরেশনে এবং মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব মোস্তফা জামান মিলনের সঙ্গে যোগাযোগ হলে মোবাইল ফোনে কল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু ফোন কল ও এসএমএস করেও মেয়রের সাড়া পাওয়া যায়নি। হোয়াটাসঅ্যাপ মেসেজেরও জবাব দেননি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়