নির্বাচন
বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই হবে বলে জানিয়েছে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা করা হবে এর অন্তত মাসখানেক আগে। অর্থাৎ নভেম্বরে। এখন চলছে সেপ্টেম্বর মাস। আসন্ন নির্বাচনকে ‘সফল’ করে তোলার জন্য নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছে বলে মনে হচ্ছে। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আবেগ, উচ্ছ্বাস, উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির সঙ্গেও বৈঠক করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি এবং বিভিন্ন বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তারা আসন্ন নির্বাচনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে চাইছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি প্রবাসীদের কথা কিছু ভাবছে?
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া যেসব নাগরিক বিদেশে চাকরি করছেন, তারাই প্রবাসী হিসেবে গণ্য। বয়সের হিসাবে তারা সবাই ভোট প্রদানের উপযুক্ত। ধারণা করা হয়, ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। যে কোনো বিচারে সংখ্যাটা বিশাল। মোট জনসংখ্যার দিক থেকে এ সংখ্যা ৮ শতাংশের ওপরে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার ভোটার প্রবাসী হিসেবে কর্মরত। বলার অপেক্ষা রাখে না, আসনভিত্তিক এই সংখ্যা যে কোনো আসনের ভোটের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা পালন করতে পারে। ফলে বিশালসংখ্যক প্রবাসীকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একটি নির্বাচন প্রকৃত অর্থে অসম্পূর্ণ নির্বাচন ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। বিবিসির সূত্রমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশই আসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে। বাংলাদেশের প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, বৈশ্বিক মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সর্বোপরি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বাংলাদেশ এখনও যতটুকু টিকে আছে, তা মূলত প্রবাসীদের কল্যাণেই। রাষ্ট্র থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা না নিয়েও তারা নিজেদের কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন; সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছেন। অথচ অর্থনীতির জীবনীশক্তি প্রদায়ী এসব মানুষের প্রতি রাষ্ট্র কদাচিৎ দায়িত্ব পালন করে। রাষ্ট্র এমনকি তাদের ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত রাখছে। এটা কেবল প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের চরম উদাসীনতাই নয়, এক ধরনের অন্যায়ও বটে।
এই অন্যায় থেকে পরিত্রাণে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে এ যুক্তিই যথেষ্ট– তারা বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু এর বাইরেও অনেক কারণে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের সুযোগ তৈরি করা দরকার। প্রথমত, প্রবাসীদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা বিশাল জনগোষ্ঠীর অবদানকে স্বীকার করা হয়। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক আরও নিবিড় হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডে পরোক্ষভাবে প্রবাসীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। কারণ যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় সব নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। চতুর্থত, প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের চলমান উদাসীনতা এবং অন্যায়ের কিছুটা অবসান ঘটে।
কাজটি হয়তো খুব সহজ নয়। এ জন্য আইন পরিবর্তন ও সংশোধন দরকার হতে পারে। প্রবাসীদের তথ্য ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিও একটা সমস্যা হতে পারে। এমনকি তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ, ভোটের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখাও বিরাট চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, প্রবাসীদের আস্থা অর্জন করা। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও দরকার সমানভাবে। তবে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য যত চ্যালেঞ্জই থাকুক না কেন, কোনোটিই সমাধানের অযোগ্য নয়। কর্তৃপক্ষ সচেতন এবং আন্তরিক হলে সব চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করা সম্ভব।
আইনি জটিলতা থাকলে বর্তমান সংসদেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন পরিবর্তন ও সংশোধনী আনা সম্ভব। প্রবাসীদের তথ্য ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিতে জটিলতা থাকলে তাও বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা থাকতে পারে। কারণ প্রবাসী ভোটের ক্ষেত্রে একটি সেন্টারে একাধিক সংসদীয় আসনের ভোটার থাকতে পারেন। এমন ক্ষেত্রে ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট নেওয়ার সুযোগ রাখলে জটিলতা অনেক ক্ষেত্রে কমে আসতে পারে।
সব শেষে এটা মনে রাখা দরকার, প্রবাসীদের ভোটাধিকার শুধু সুযোগ নয়; তাদের অধিকার। এটা গণতন্ত্রের দাবিও বটে। আশা করি, আসন্ন নির্বাচনের আগেই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সফিক ইসলাম: শিক্ষক এবং বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।