সামনে নির্বাচন, সময়টা খারাপ : ওবায়দুল কাদের

আগের সংবাদ

‘সব ধর্মের আদর্শ ধারণ করেই এগুতে হবে’

পরের সংবাদ

গবেষণায় ‘অপ্রতুল’ বরাদ্দ, তাও অর্ধেক খরচ হয়নি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ , ৩:৫৬ পূর্বাহ্ণ আপডেট: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ , ৩:৫৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থ অপ্রতুল এবং তা আরও বাড়ানোর দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু সেই ‘অপ্রতুল’ বাজেটের অর্ধেক অর্থও খরচ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। যে গবেষণা কেন্দ্রগুলো ভালো করছে, তাদের কার্যক্রমের কোনো তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে মাত্র ৪ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা খরচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রগুলো, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে ২১টি কেন্দ্র কোনো টাকাই ব্যয় করেনি। গত দুই অর্থবছর থেকে উদ্ভাবন খাতে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এক টাকা খরচ হয়নি।

চলতি অর্থবছরে গবেষণা মঞ্জুরি খাতে মোট ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রগুলোতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গবেষণা মঞ্জুরির অর্থ মূলত বিশেষ অনুদান এবং ৫৮টি গবেষণা কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটে দেওয়া হয়। এই কেন্দ্রগুলোর কয়েকটি এমনও আছে, যেগুলোতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো পরিচালক নেই, অর্থাৎ এটির কোনো কার্যক্রমও নেই। তবু প্রতিবছরই এগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেই টাকা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। কিছু কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই, কেউ কোনো গবেষণা না করেই দুয়েকটি সভা-সেমিনার করেই টাকা খরচ করছে। অথচ যে কেন্দ্রগুলো ভালো গবেষণা করছে, তারা পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাচ্ছে না।

গত পাঁচ বছরে গবেষণা বরাদ্দের নথিপত্র থেকে দেখা যায়, কোনো বছরেই পুরোপুরি অর্থ খরচ হয়নি। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, বরাদ্দের টাকাই ব্যয় হচ্ছে না, এতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে বরাদ্দ বাড়াতে সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের দীর্ঘসূত্রতাকে দুষছেন সেন্টারের পরিচালকরা। তারা বলছেন, সেন্টারের কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে নতুন জিনিসপত্র কেনা দরকার। নতুন প্রকল্পের জন্য বাজেট দরকার। কিন্তু প্রশাসনিক ভবনে ফাইল পাঠানো হলে অনুমোদিত হতে তিন-চার মাস লেগে যায়। অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২১-২২ বার্ষিক বিবরণীর তথ্যমতে, বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই। ইস্ট এশিয়ান স্টাডি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন পিএসসির সদস্য হয়েছেন। এখন কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই। সেন্টার ফর কালচার অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো পরিচালক নিয়োগ হয়নি। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র ও সেন্টার ফর আরবান রেজিলিয়েন্স স্টাডিজের কোনো পরিচালক নেই। এগুলোতে প্রতিবছর বরাদ্দ হচ্ছে আর তা অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে।

আবার গবেষণা মঞ্জুরি খাতের কেন্দ্রগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হলেও সবাই গবেষণা করছে না। বায়োইনফরমেটিক্স লার্নিং অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেমিক ট্রেনিং সেন্টারটি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ হাজার টাকা, শিক্ষকদের জন্য ৮ হাজার টাকা ও পেশাজীবীদের জন্য ১০ হাজার টাকায় অনলাইনে বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স পরিচালনা করে থাকে। অ্যারাবিক টিচিং ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে জুমে দু’দিনব্যাপী কর্মশালা এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ওশান গভর্ন্যান্স সেন্টার সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ২৩ জন ও তৃতীয় বর্ষের ১৯ শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী হাইড্রোগ্রাফিক ইউনিটে পরিদর্শন এবং সমুদ্র গমনের ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বর্ষের ছয় শিক্ষার্থীকে নৌবাহিনীর জাহাজে বঙ্গোপসাগর থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য ফিল্ড ট্রিপ করেছে। সেন্টার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশনের কোনো কার্যক্রম নেই। পরিচালক অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম সমকালকে বলেন, সেন্টারটি তো এখন আর নেই মনে হয়। আমাকে পরিচালক বানিয়ে রাখা হয়েছিল। আমি কখনও এর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। এটা চালু করা যায় কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তা বলতে পারব না। বাংলাদেশের সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের কোনো অফিস নেই, লোকবলও নেই। সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান বলেন, আমি ২০১৮ সাল থেকে আর পরিচালক নেই। এখন এই সেন্টারে সম্ভবত কেউ নেই।

সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ স্টাডি অ্যান্ড রিসোর্স ইউটিলাইজেশনের পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অবসরে গেছেন এক বছর হলো। তবে এখনও এতে কোনো পরিচালক নিয়োগ হয়নি। বর্তমানে এটি হিমাগারে পড়ে আছে। অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইংলিশ টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের একটি জার্নাল ও তানভীর মোকাম্মেল ফিল্ম সেমিনার করেছে, বুড্ডিস্ট হেরিটেজ অ্যান্ড কালচার সেন্টার দুটি সেমিনার ও সভা করেছে। আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ কেন্দ্রটি সশরীরে ও জুমে চারটি সেমিনার, একটি সম্প্রীতি সন্ধ্যা গানের আসর, বিতর্ক উৎসব, ছোটগল্প চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা করেছে। নৈতিকতা উন্নয়ন কেন্দ্র ছয়টি ওয়েবিনার ও একটি সেমিনার করেছে। ড. সিরাজুল হক ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রে দুটি জার্নালের কাজ চলমান রয়েছে। এদের কেউই ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ করতে পারেনি।

কটলার সেন্টার ফর মার্কেটিং এক্সিলেন্সের পরিচালক ফারহাত আনোয়ার জুলাইয়ে অবসরে গেছেন। এটিতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজ হচ্ছে না। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টার থেকে ২০১৯ সালে আটজন শিক্ষক মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছেন– এ তথ্যটিই বিগত বছর ধরে উল্লেখ করে আসছে। এটির আর কোনো কার্যক্রম নেই।

সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টার, ব্যবসায় গবেষণা ব্যুরো, উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র, পলিসি অন বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস সেন্টার, উচ্চতর মানববিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, কালচার অ্যান্ড ডিসলিনেট সেন্টার, রঙ্গলাল সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, ব্যাংকিং ইন্টারপ্রেনারশিপ ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি কেন্দ্রগুলো গত বছরে বেশির ভাগ বরাদ্দ খরচ করেনি।

বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক রাখহরি সরকার বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে গবেষণা প্রস্তাব চূড়ান্ত করি। কিন্তু প্রশাসন থেকে টাকা দিতে দেরি করে। এতে সহকর্মীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ জন্য সমস্যা হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিসার্চ উইং দরকার। বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আবদুর রহমান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে দীর্ঘসূত্রতা আছে। আমি সেন্টারের চাহিদাপত্র চেয়ে ফাইল পাঠিয়েছি দুই মাস হলো, সেটি এখনও অনুমোদন হয়নি। তার ওপর বারবার অনুরোধ করতে হয়, এতে অসুবিধা হয়।

এ বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউজিসি আমাদের চারবারে টাকা দেয়। আমরা গবেষণার ক্ষেত্রে তিনবারে বা দু’বারে টাকা দিই। কেন্দ্রগুলো রিকুইজিশন দিতে যদি ভুল করে, তখন দেরি হয়। আর অনেকে টাকা খরচ করতে পারছে না, এটা সত্য। সে জন্য কেন্দ্রগুলো থেকে চাইতে হবে। ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, গবেষণার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য কমে গেছে। গবেষণা না করলেও পদোন্নতি করা যায়। এখন রাজত্ব চলছে অর্থের, শিক্ষকরাও তার দ্বারা প্রভাবিত। গবেষণার চেয়ে যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যায়, কনসালট্যান্সি করা যায়– তারা সেটা ভাবছেন। তবে গবেষণা যে হচ্ছে না তা নয়, যারা করার তারা করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বিশ্ববিদ্যালয়বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা নিয়ে হচ্ছে না। কারণ এখান থেকে অর্থ নিতে অনেক জটিলতা থাকে।

তিনি আরও বলেন, গবেষণার পাশাপাশি প্রকাশনা করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থা শক্তিশালী নয়। এদিকে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। আবার কেউ গবেষণা প্রকাশনা করলেন; কিন্তু সেটা আলোচনা, সেমিনার হয় না। গবেষণা, প্রকাশনা ও আলোচনা তিনটিই একত্রে দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত, শিক্ষকদের উৎসাহিত করা। আবার শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও আগ্রহ থাকা দরকার। এটা তো আর অর্থের সঙ্গে মেলানো যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় গতিশীলতা আনতে বিশ্ববিদ্যালয় গত জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ কো-অর্ডিনেশন অ্যান্ড মনিটরিং সেল অনুমোদন করেছে। এটির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ শাহাদাত হোসেন বলেছেন, আমাদের লোকবল, অফিসের জায়গা বরাদ্দ, নীতিমালার প্রাথমিক খসড়া ইত্যাদি প্রাথমিক স্তরে আছে। ধীরে ধীরে কাজ হচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহে আমরা একটা পর্যায়ে আসতে পারব আশা করছি। আগামী মাস থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমরা রিসার্চ মনিটরিং সেল করেছি। আমরা তো ইমার্জিং, আমাদের সীমাবদ্ধতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। যা কিছু করি, অনেক ঘাটতি নিয়েই আমাদের শুরু করতে হয়। এটা পুরোপুরি হলে প্রতিবন্ধকতা কেটে যাবে। আর শিক্ষকরা যথাসময়ে টাকা না পেলে আমাদের জানাবেন। এটা বিলম্ব হওয়া কাম্য নয়। এটা আমাদের অগ্রাধিকার কাজ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, রূপান্তর প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়